প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ

অপরাধ এইমাত্র জীবন-যাপন

এবার প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয়ে প্রতারণা

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : সারাদেশেই এখন প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ। শহর থেকে গ্রামগঞ্জে বিস্তৃত প্রতারকদের নেটওয়ার্ক। সঙ্ঘবদ্ধ চক্রগুলো নিত্যনতুন কৌশলে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন মানুষ। অশিক্ষিত থেকে উচ্চশিক্ষিত এমনকি বাদ যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।সম্প্রতি প্রতারকচক্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা করতে গিয়ে গ্রেফতারও হচ্ছে।
এ বার ধরা পড়লো প্রধানমন্ত্রীর পিএস-১ পরিচয়দানকারী এক প্রতারক। সোমবার র‌্যাব অভিযান চালিযে আব্দুল মতিন নামের এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে।
জানা গেছে, প্রথম শ্রেণি পাশ লক্ষ্মীপুরের আব্দুল মতিন। নিজেকে পরিচয় দেন প্রধানমন্ত্রীর পিএস-১ হিসেবে। সে এই পরিচয় দিয়েই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রুপ পাল্টিয়ে নানা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। ব্যাংক বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, জাল টাকা ও মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। সোমবার দুপুর ১২টায় লক্ষ্মীপুর জেলা স্টেডিয়ামে র‌্যাব-১১ সিপিসি-৩ এর পক্ষ থেকে এতথ্য জানানো হয়েছে। র‌্যাব জানায, লক্ষীপুর জেলার রামগতি চরগাজী ইউনিয়নের চর আফজাল গ্রাম থেকে প্রতারক মতিনকে গ্রেফতার করা হয়।
জানা গেছে, লক্ষীপুরের রামগতির চর আফজাল গ্রামের মৃত আব্দুর রবের ছেলে আব্দুল মতিন দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছে। নিজের দুটি এন আইডি তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন নাম ঠিকানা ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে আসাছিল। গ্রেফতারকৃত মতিনের কোন বৈধ পেশা নেই। সে একজন প্রতারক, জাল টাকা ও মাদক ব্যবসায়ী। এমন খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এসময় তার দখল থেকে ৫০ পিস ইয়াবা, ১ লাখ ৩৯হাজার টাকা মূল্য মানের জাল টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ২টি সীল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১০টি ভুয়া প্যাড, ২টি খাম, তার ও তার পিতার বিভিন্ন নামীয় আইডি কার্ডসহ আলামত জব্দ করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে ১২ টি মামলা ছিল। গতকালের ঘটনায় আরো তিনি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সুত্র জানায়, অপরাধের সিংহভাগ এখন প্রতারকদের দখলে। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, লোভনীয় চাকরি, বিদেশে লোক পাঠানো, বিদেশি উপহার, বিয়ে-তালাক এমনকি করোনার নমুনা পরীক্ষার নামে চলছে প্রতারণা।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী দাবি করা আইয়ুব আলী নামে এক ব্যক্তি পেশায় মুদি দোকানি। মাধ্যমিকের গ-ি পাড়ি দিতে না পারলেও রপ্ত করেছেন প্রতারণার বহুমাত্রিক কৌশল। মোটা অংকের বেতন দিয়ে রেখেছেন একজন ব্যক্তিগত সহকারীও। কথায় কথায় পুলিশকে ধমক দেওয়া এ কথিত বিশেষ সহকারীও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। নিয়োগ, বদলি, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা ধরণের তদবিরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রটোকল অফিসারের ভুয়া সিল স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন আইয়ুব আলী। নিজেকে পরিচয় দিতেন ওই প্রটোকল অফিসারের ছেলে হিসেবেও।
গত মার্চ মাসের প্রথম দিকে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন এলাকা থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভুয়া উপপরিচালক পরিচয়দানকারী প্রতারককে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪ ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)। গত ১৪মার্চ র‌্যাবের এক প্রেস বিজ্ঞতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নাম নাজমুল আহসান বিজয় ওরফে আমিনুল ইসলাম জন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপপরিচালক এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)এর উপ-পরিচালক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাত করে আসছিল। এমন তথ্য র‌্যাব ও এনএসআইয়ের কাছে আসে। দীর্ঘদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার পর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া তাকে গ্রেফতার করা হয়।গত ১৩মার্চ এনএসআইয়ের সহযোগিতায় পেশাদার প্রতারক চক্রের মূলহোতা নাজমুল হাসান ওরফে আমিনুল ইসলাম জনকে (৩৯) মিরপুর-১,আহম্মেদ নগর, জোনাকি রোড থেকে আটক করে র‌্যাব-৪। এ সময় তার কাছ থেকে প্রতারণা কাজে ব্যবহৃত নথিপত্র ও ভুক্তভোগী কর্তৃক ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদত্ত ১লাখ টাকা প্রদানের স্লিপ, ১৯টি উপ পরিচালক, এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো এর ভিজিটিং কার্ড ও ১টি উপ পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো এর ভুয়া পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়।
র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার কথা স্বীকার করে সে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর উপ পরিচালক, কখনো এনএসআই এর উপ পরিচালক পরিচয় দিয়ে সাধারণ ছাত্র, বেকার যুবক এবং দরিদ্র ছাত্রদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির আশ্বাস দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
অভিজ্ঞমহল বলছেন, প্রতারক চক্রের হাত থেকে রেহাই পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে লোভে পড়লেই ঘটবে সর্বনাশ। প্রতারক চক্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছেন। কোনো কোনো চক্রে আছেন বিদেশিরাও। লোকলজ্জা ভয়ে,কেউ বাড়তি ঝামেলার ভয়ে নীরব থেকে যাচ্ছেন।
গত ২ মার্চ রাতে রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিনব প্রতারক চক্রের ৫সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তারা জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার থেকে বিভিন্ন লোকের এনআইডির ছবি পরিবর্তন করে ওই এনআইডি দিয়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ তুলে লাপাত্তা হয়ে যেত। ঋণ নেয়ার কাজে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স, ভুয়া টিআইএনও ব্যবহার করত চক্রটি। এভাবে এরা ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।আর গত ২৪ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানা পুলিশ গ্রেফতার করে জাহিদুর রহমান ইকবাল নামের এক প্রতারককে। সে নিজেকে ‘বনবন্ধু’ নামে পরিচয় দিত। কাওরানবাজারে ভুয়া কোম্পানি খুলে প্রতারণার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে গাছ লাগানোর কথা বলে ৪০ হাজার প্রতিষ্ঠানে মুজিববর্ষের লোগো ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী ব্যবহার করে চিঠি দেয়।
তিনি গ্রেফতারের পর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ বলেন, শুধু গাছ লাগানোর কথা বলে নয়, সে ভুয়া কনসালটেন্সি ফার্ম খুলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে ব্যাংক ঋণ করিয়ে দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এছাড়া গত ২৩ফেব্রুয়ারি এক প্রতারক চক্রের ৯সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তারা রিয়েল এস্টেট ব্যবসার আড়ালে ২৪মাসে দ্বিগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে অফিস খুলে বসে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিত। পরে অফিস পরিবর্তন করে আবার নতুন নামে প্রতারণা চালাত। এভাবে তারা ৫শতাধিক লোককে সর্বস্বান্ত করেছে। গত ২৪ফেব্রুয়ারি খিলক্ষেত নিকুঞ্জ-২এলাকা থেকে জহিরুল আলম, রবিউল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম ও উত্তম তালুকদার নামে ৪প্রতারককে গ্রেফতার করে সিআইডি। তারা চাকরি এবং বিদেশে পাঠানোর নামে চাকরি প্রার্থী লোকজনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারক জহিরুল ইসলাম নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করত বলে সিআইডি জানিয়েছে।
পিবিআই অপর এক প্রতারক চক্রের সদস্য আক্তারুজ্জামান, সালাম, মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আবু তাহের জবা ও শফিকুল ইসলাম স্বপনসহ ৬জনকে গ্রেফতার করে। তারা দুর্লভ নাসার কয়েন কিনে আবার বিক্রি করলেই কোটি টাকা লাভ। এ লোভে এই চক্রের হাতে সম্প্রতি শিল্পপতি থেকে শুরু করে সরকারি আমলারাও খুইয়েছেন কোটি কোটি টাকা। একটি কাঠের তৈরি কয়েনকে নাসার কয়েন বলে প্রলোভন দেখাত চক্রটি। বলত, গবেষণার কাজে কয়েনটি নাসায় ব্যবহৃত হয়। এটি কিনে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা যাবে। যার ক্রয়মূল্য ১০ কোটি টাকা। মার্কিন মুলুকে কয়েনটির ব্যাপক চাহিদা। পিবিআই জানায়, এ নাসার কয়েন চক্রের খপ্পরে পড়ে সম্প্রতি সরকারের প্রথম শ্রেণির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার পেনশনের ১কোটি ৪৮লাখ টাকা খুইয়েছেন। আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুইয়েছেন ৮৪ লাখ টাকা। স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী ২ কোটি টাকা হারিয়েছেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার গণমাধ্যমে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন প্রতারকদের পাকড়াও করতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। তেমনি প্রতারক চক্রও দিন দিন অভিনব কৌশল বের করে প্রতারণার চেষ্টা করছে। তাই প্রতারক চক্র থেকে দূরে থাকতে হলে লোভকে বর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে একটু সচেতন থাকলেই ভয়াবহ ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।


বিজ্ঞাপন