২০০ কিমি বেগে আঘাত হানতে পারে ‘ইয়াস’

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

উত্তাল সাগর, উপকূলে ফিরছে মাছ ধরার ট্রলার
গতিপথ বদলেছে ইয়াস, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ৪ জেলা
দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে জানালেন দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : শক্তি সঞ্চয় করে আরও ঘনীভূত হয়ে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এ পরিণত হয়েছে। এটি এখন ওই এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। উপকূলে আঘাত হানার পর ঘূর্ণিঝড়টি টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা তা-ব চালাতে পারে বলে জানা গেছে। এ সময় বাতাসের গতি ঘণ্টায় গড়ে ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস।
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ প্রসঙ্গে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি মূলত পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বিহার উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে। আমার ধারণা এটি ২৬ মে বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে উপকূলে আঘাত হানবে। তবে বাংলাদেশে বাতাসের গতিবেগ ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আঘাতের কেন্দ্রস্থলে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি হতে পারে। তবে টানা ঝড় বয়ে যাওয়ার সময় গতি গড়ে ১৮০ কিলোমিটার থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া বিশেষ বার্তায় বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড়টি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
উত্তাল সাগর, উপকূলে ফিরছে মাছ ধরার ট্রলার : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাগরে প্রবল ঢেউ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো উপকূলে ফিরতে শুরু করেছে। সোমবার ভোর থেকে দুর্যোগ আতঙ্কে উপকূলীয় বিভিন্ন খালে ও নদীতে মাছ ধরা শতাধিক ট্রলার আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বুধবার (২৬ মে) সুপার সাইক্লোন হয়ে উপকূলে আঘাত হানার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে সাগর উত্তাল থাকায় দুর্যোগের মুখে পড়েছে অনেক মাছ ধরা ট্রলার। ইয়াসের প্রভাবে রাত থেকেই গভীর সমুদ্রে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ফিরে আসা জেলেরা।
বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরে আসা জেলে আবুল কালাম বলেন, চার-পাঁচ দিন সাগরে জাল বাইছি, মাছ নাই। হঠাৎ করে রোববার সন্ধ্যায় নদীর পানি খুব উত্তাল হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হলে আমরা দ্রুত কূলের দিকে চলে আসি। আরও অনেক জেলে এরকম ঝড়ের কবলে পড়েছে।
ট্রলারের আরেক মাঝি আইয়ুব আলী বলেন, রেডিওতে অল্প অল্প ঝড়ের খবর শুনছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মেঘ এবং ঢেউ শুরু হলে আমরা দ্রুত উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হই। আমাদের মতো অনেক ট্রলার ফিরে আসছে।
উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, সাগরে মাছ ধরা যে ট্রলারগুলো ছিল সেগুলো তীরে ফিরতে শুরু করেছে। কিছু ট্রলার তীরে নোঙ্গর করেছে। অন্য ট্রলারগুলোও দ্রুত সময়ের মধ্যে ফিরে আসবে বলেও জানান তিনি।
গতিপথ বদলেছে ইয়াস, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ৪ জেলা : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলায়। গতিপথ পরিবর্তন করায় এসব এলাকার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে না গেলেও দমকা হাওয়াসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই চার উপকূলীয় এলাকা। এদিকে, অনুকূল আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে ঘূর্ণিঝড়টি আরও ঘনীভূত হয়ে আরও উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। ২৬ মে ভোর নাগাদ উত্তর উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের খুলনা উপকূলের কাছ দিয়ে উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় পৌঁছাতে পারে। আবহাওয়া অফিসসূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সোমবার ভোরে পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের। ঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ৮৮ কিলোমিটার। তবে এটি আগের অবস্থান থেকে সামান্য সরে গেছে। এজন্য এখন বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের উড়িষ্যা উপকূলে ঝড়টি আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর। যদি আবারও ঘূর্ণিঝড়টি দিক পরিবর্তন করে তাহলে বাংলাদেশের উপকূলের দিকেও আসতে পারে। এক্ষেত্রে ঝড়টি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলাকে আঘাত করতে পারে।
এখন ঝড়ের কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ৬২ কিলোমিটার। এই গতিবেগ দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের কাছের সাগর বিক্ষুব্ধ অবস্থায় আছে। দেশের চার সমুদ্র বন্দরকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ২ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, ‘আগামীকাল অর্থাৎ মঙ্গলবার দিনগত মধ্যরাত থেকে এই ঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে। ঝড়টি কিছুটা গতিপথ পরিবর্তন করায় এখন বাংলাদেশের দিকে না এসে ভারতের উড়িষ্যার দিকে যাচ্ছে। তবে যেকোনও সময় এই ঝড়ের গতিপথে পরিবর্তন ঘটতেও পারে। ঝড় এলে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলা ল-ভ- হবে, আর না এলেও এর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়বে এই চার জেলা।’
আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত বিশেষ সতর্ক বার্তায় বলা হয়, পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে এবং এর আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াস দুপুর পর্যন্ত প্রায় একই এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৬৮৫ কিলোমিটার থেকে কিছুটা এগিয়ে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছে। কক্সবাজার থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এগিয়েছে। কিন্তু মোংলা ও পায়রা থেকে একই দূরত্বে আছে এখনও। মোংলা বন্দর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে।
এদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, ঝড়টি ভারতের আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৬০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থান করছে। একইভাবে উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপ থেকে ৫৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্বে, বালাসোর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্বে এবং পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব দীঘা থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে।
তারা বলছে, এটি খুব সম্ভবত উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে। এরপর আরও শক্তিশালী হয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। এটি যত উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকবে, আরও তীব্র হবে এর গতি। ২৬ মে উত্তর উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের কাছে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাতে পারে। ২৬ মে সকালেই উত্তর উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ প্যারাদ্বীপ অতিক্রম করতে পারে। ২৬ মে সকালে ইয়াস সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতর।
দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে জানালেন দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই বলে মন্তব্য করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এমপি। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি এখনও শক্তিশালী হয়নি। এটির কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ৬২ কিলোমিটার। এই মুহূর্তে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।’
সোমবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘ইয়াস’ মোকাবিলা বিষয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে বেশ দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। এটি ভারতের উড়িষ্যার দিকে যাচ্ছে। যদি গতিপথ পরিবর্তন না করে, তবে বাংলাদেশের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
এনামুর রহমান বলেন, ‘এটি বাংলাদেশে আঘাত করলে, মোকাবিলা করার জন্য আমাদের ভলান্টিয়াররা প্রস্তুত আছেন। প্রস্তুত আছেন আমাদের জেলা প্রশাসকরা। আমরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।’
সভায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন, আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শমসুদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।


বিজ্ঞাপন