সাইবার জগৎ : কিশোর-তরুণদের অবক্ষয়

অপরাধ এইমাত্র

বিশেষ প্রতিবেদক : অনলাইন এবং অ্যাপ ব্যবহার করে সাইবার অপরাধের জগতে প্রবেশ করছে বাংলাদেশের কিশোর-তরুণরা। জুয়া, পর্নোগ্রাফি থেকে মানব পাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের মাফিয়া রাজ্যে অবস্থান এখন তাদের। সবচেয়ে বড় শঙ্কা ও অস্বস্তির বিষয় এটাই যে, বাবা-মায়ের সামনে বসেই তরুণরা এই সর্বনাশির খেলায় মত্ত থাকলেও এই বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই তাদের।
সম্প্রতি সংঘবদ্ধভাবে এক নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় ভারতের ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ পাঁচ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের একজন এ ভি হৃদয়। তিনি ‘টিকটক হৃদয়’ নামে পরিচিত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, টিকটক অ্যাপে কাজ করার প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচারের অপরাধ করে আসছিলো হৃদয়। তিনিসহ ভারতে আটককৃতরা বাংলাদেশ থেকে এক তরুণীকে পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে নির্যাতন করে। সেই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরেই ভারতের পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।
অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণা, যৌন হয়রানিসহ আরও অনেক অপরাধ বাংলাদেশে আগে থেকেই চলছে। কিন্তু নতুন ধরণের এই অপরাধ শঙ্কার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এইসব অপরাধের জন্য অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অ্যাপে অপরাধীদের নানা ধরণের গ্রুপ আছে। তদন্তে সেসব গ্রুপ-এর নাম জানা যাচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর এলএসডি মাদকের সন্ধান পেয়েছে। এই মাদকের যোগাযোগও চলে অনলাইনে। ফেসবুকে এই মাদক সেবন ও সরবারাহকারীদের একাধিক গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া গত অক্টোবরে অনলাইন পর্নোগ্রাফির সাথে যুক্ত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা পর্নোগ্রাফির বাজার গড়ে তুলেছিলো উন্নত বিশ্বে। নানা প্রলোভন আর বন্ধুত্বের আড়ালে তারা পর্নোগ্রাফি তৈরি করত। এর আগেও ২০১৪ সালে এরকম আরেকটি গ্রুপ ধরা পড়ে।
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তাদের কাছে ২০১৮ সালে সরাসরি ঢাকা শহর থেকে অভিযোগ আসে এক হাজার ৭৬৫টি। এছাড়া হ্যালো সিটি অ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ পাওয়া যায় ছয় হাজার ৩০০। ২০১৯ সালে সরাসরি অভিযোগের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯৩২টি। আর হ্যালো সিটি অ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ পাওয়া যায় ৯ হাজার ২২৭টি। ২০১৯ সালে মোট অভিযোগের ৫৩ শতাংশ করেছেন পুরুষ আর বাকি ৪৭ শতাংশ।
অনলাইনকেন্দ্রিক অপরাধমূলক কর্মকা- প্রতিরোধে বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধের প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে। তবে তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা মনে করেন, অ্যাপস বন্ধ করা যেমন কঠিন তেমনি সেগুলো নিষিদ্ধ করেও লাভ নাই। ‘নিষিদ্ধ করে ব্যবহার ঠেকানো যায় না। এর জন্য দুইটি বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের সক্ষমতা আরো বাড়ানো এবং দরকার প্যারেন্টাল গাইডেন্স,’ বলেন তিনি। তার মতে, ‘সন্তান যে গ্যাজেটটি ব্যবহার করছে তার প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অন করে দিতে হবে। ফলে সন্তান যদি কোনো নিষিদ্ধ অ্যাপ ব্যবহার করে, সাইটে ঢোকে বা গ্রুপে তৎপর হয় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার নোটিফিকেশন পাবেন।’
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে সাইবার অপরাধের ধরন প্রতিদিনই পাল্টে যাচ্ছে। আমরাও সেই অনুযায়ী আমাদের তদন্ত, অনুসন্ধান এবং প্রযুক্তি আপডেট করছি। ঢাকায় সাইবার অপরাধ দমনে আমরা সক্ষম। কিন্তু সারাদেশে সেই সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তবে কাজ চলছে। প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হচ্ছে।’ তিনি জানান, তাদের নীতি হলো কোনো অ্যাপ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ঢালাও বন্ধ না করা। অপরাধ চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া তবে জুয়াসহ আরও কিছু অ্যাপ আছে যা, নিষিদ্ধ।
সমাজের দিকে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, সামান্য বিষয়ে খুন হচ্ছে শিশুরা। একই সাথে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেড়েছে হত্যার ঘটনা। গত ১৭ বছরে শুধু ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামাজিক অবক্ষয়ের বলি হচ্ছে শিশু-কিশোররা। পুলিশ বলছে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীল হতে হবে অভিভাবকদেরও।
চার মাসের মেয়ে সাদিয়ার জন্য শখ করে চুড়ি কিনেছিলেন মা। কিন্তু ঝাড়ু দেওয়ার পর আবর্জনা পাশের ঘরে উড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র দুই পরিবারের দ্বন্দ্বে জবাই করে খুন করা হয় শিশুটিকে। তার কাপড় এখনো সযতেœ রেখেছেন মা মোর্শেদা বেগম।
বিভিন্ন সংঠনের পরিসংখ্যান বলছে গত বছরই ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৪৫ শিশু। নানা তুচ্ছ ঘটনার জেরে ২০১৯ সালে হত্যা করা হয় ৪৪৮ শিশুকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে এ ধরণের অপরাধ কমছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, সূত্রটা অন্য জায়গায়, কোনোভাবেই সে কিছুই করতে পারছে না। প্রচ- রকমভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার একটা প্রতিফলন।
আরেক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, বাড্ডাসহ ঢাকার ৪০টি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে গত ১৭ বছরে ১২০ জন খুন হয়েছেন। গত দুই বছরে কিশোর অপরাধীদের হাতে মারা গেছে ৩৪ জন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, সমাজের মধ্যে বৈষম্য দারিদ্র তারপর অনেক রকম সমস্যা থাকে সেইটার একটা প্রতিফলন কিন্তু শিশু কিশোর অপরাধের মধ্যদিয়ে হয়।
পুলিশ বলছে গত কয়েক বছরে কিশোর অপরাধী নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। অভিভাবকদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ তাদের।
গোয়েন্দা অপরাধ তথ্য বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আইন আদালত, পুলিশ বিভাগ যথেষ্ট না, পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে পরিবারের সবাইকে বোঝাতে হবে। এই অপরাধ হ্রাস করার জন্য শুধু শাস্তি দেয়ার জন্য জেলখানায় পুরে রাখলে একটা জাতি কারাগারে অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে।
এলাকাভিত্তিক একাধিক গ্রুপ তৈরির খবর পাওয়া যাচ্ছে ঘন ঘন। কে কোথায় আসতে পারবে, কে পারবে না, কার ক্ষমতা কত বেশি, কে কার সিনিয়র, কে জুনিয়র এ নিয়ে কিশোরদের মধ্যে হরহামেশাই হচ্ছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও হাতাহাতি। কখনও তা রূপ নিচ্ছে হত্যাকা-ে। কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পরার প্রবণতা আগে থাকলে এর পরিমাণ সম্প্রতি অনেকাংশেই বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এর অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন তারা।
কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পরার পেছনে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্টতা ও তা অনুকরণ, সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক প্রেক্ষাপটে পারিবারিক অনুশাসন কমে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে কিশোরদের জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। চ্যালেঞ্জগুলো কঠিন। সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে কিংবা সাধারণভাবে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কেমনভাবে সহজ সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, তাতে পরিবেশের ভূমিকা বড়, অভিভাবকদের এ বিষয়ে মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়েদের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সমাজে চাই নানান গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ। চাই বড়দের কার্যকর নির্দেশনা ও সক্রিয় সাহচর্য। অথচ তাদের পাশে মা-বাবা, শিক্ষক বা সমাজ সেভাবে নেই। তারা অভিভাবকহীন বড় হচ্ছে। যথাযথ অভিভাবকত্বও কিন্তু শেখার বিষয়। মা-বাবাসহ সমাজের অভিভাবকেরা যোগ্যতায় পিছিয়ে আছেন, এমনকি এ বিষয়ে সচেতনও নন। তারই খেসারত দিচ্ছে কিশোর ও তরুণেরা। এই শূন্যতা, এই অযোগ্যতা পূরণ আজ পরিবার, সমাজ ও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, কিশোর-তরুণদের অপরাধ প্রবণতার মূলে রয়েছে সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। পরিবারসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছোটবয়স থেকে নৈতিক মূল্যবোধের সঠিক চর্চার অভাবে ধীরে ধীরে একদিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অপরাধ কর্মের বিভিন্ন শাখায় তারা জড়িয়ে পরে নিজের অজান্তেই।
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বড় পার্থক্য হল, মানুষ নৈতিকতাসম্পন্ন জীব, অন্য প্রাণী তা নয়। ন্যায় আর সত্যের পথ অনুসরণ করে অন্যের ক্ষতি না করে যতটুকু সম্ভব উপকার করা, অপরের কল্যাণ করা প্রতিটি নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের কাজ। মানবজীবনের উন্নয়নে ও মানবকল্যাণের সব বিষয়ের প্রধান নির্ণায়ক হল নৈতিকতা।
একদিন দুইদিনে অবস্থার সমাধান হবে না বলে আমরা মনে করি। তবে আমাদের ধারণা, শিশুকাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়ক্রমে সঠিক নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম থাকলে এই অবস্থার পরিবর্তন আসতে বাধ্য। শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমে কিশোর-তরুণদের প্রবেশ ঠেকানো যায়, এবিষয়ে গবেষণাসহ এর সমাধান খুঁজে বের করা সময়ের দাবি। আমাদের আশাবাদ, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।


বিজ্ঞাপন