বিশেষ প্রতিনিধি : টাকা তুলতে বা পাঠাতে বিকাশ এজেন্টের দোকানে যান তারা। কৌশলে ভিডিও করেন খাতায় থাকা নম্বরগুলো। পরে সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাগুরায় চক্রের অন্য সদস্যদের কাছে, যারা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতে বিকাশ কর্মকর্তা সেজে ফাঁদ পাতেন।
আগে থেকে ভিডিও অন করে রাখা মোবাইল ফোন দিয়ে এজেন্টের নিবন্ধন বইয়ে থাকা নম্বরগুলো ভিডিও করার মাধ্যমে শুরু হয় চক্রটির প্রতারণা পর্ব।
এরপর তারা অর্থ লেনদেনে বেশি ব্যবহৃত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান বিকাশের ‘কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা’ সেজে একে একে ফোন করতে থাকেন সংগ্রহ করা নম্বরগুলোতে।
অনেক নম্বরের মধ্যে কেউ না কেউ তাদের ফাঁদে পা দিয়ে জানিয়ে দেন ‘পিন নম্বর’, তাতেই পোয়াবারো হয় চক্রটির।
মাগুরার এই চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বিকাশে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিনব এই প্রতারণার কথা জানতে পারেন।
সোমবার চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ সালাম কবির সাংবাদিকদের জানান, মাগুরার শ্রীপুর ইউনিয়নে প্রতারণার এই কাজে জড়িত ১৩৫ জনের তালিকা পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, মাগুরার শ্রীপুর ও চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় গত শনি ও রোববার অভিযান চালিয়ে যথাক্রমে মিঠুন কুমার বালা (২৬) ও হামিদুল মোল্লা (২২) নামে দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের গ্রেপ্তারই পরই সামনে আসে প্রতারণার অভিনব এই কৌশল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
চক্রটির সদস্যরা একাধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিকাশ গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাজ করে।
এই দলে নারীরাও আছে যারা প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত বলে প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।
উপ-কমিশনার সালাম কবির বলেন, ইদানিং বিকাশ গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার কাজটি ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলে অভিযোগ পাচ্ছিলাম।
তদন্ত করতে গিয়ে মাগুরায় এমন একটি চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা বিকাশ গ্রাহকদের ‘কাস্টমার কেয়ারের’ লোক পরিচয় দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন।
তিনি জানান, তদন্তে নেমে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল দুই থেকে তিন দিন ওই চক্রের সন্ধানে মাগুরার শ্রীপুর ইউনিয়নে অবস্থান করেন। সেখানে অভিযান চালিয়ে মিঠুন কুমার বালাসহ চক্রের আরও কয়েকজনের সন্ধান পান।
গত ১২ জুন মিঠুনকে গ্রেপ্তারের পরদিন রোববার চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় এবং রাতে ইপিজেড থানার নিউমুরিং এলাকা থেকে হামিদুলকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান তিনি।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা চক্রটির কৌশলের বিষয়ে বলেন, চক্রের একজন সদস্য দেশজুড়ে ঘুরে ঘুরে বিকাশ এজেন্টের নিবন্ধন বইয়ে লেখা নম্বর সংগ্রহ করে মাগুরায় অন্য সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
পরে মাগুরা থেকে অন্যরা গ্রাহকদের ফোন করে কাস্টমার কেয়ারের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে কথা বলেন।
বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে তার সর্বশেষ লেনদেনের তথ্য তুলে ধরেন। এতে অনেক গ্রাহক সরল বিশ্বাসে পিন নম্বর দিয়ে দেন।
পুলিশ জানিয়েছে, মাগুরায় কয়েকটি চক্র রয়েছে। প্রতিটির সদস্য আট থেকে ১০ জন।
তাদের কেউ নম্বর সংগ্রহ, কেউ কাস্টমার সার্ভিস অফিসার, কেউ এডমিন অফিসার সেজে ফোন করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতারণার কাজটি করেন।
মূলত মাসের প্রথম সপ্তাহকে টার্গেট করে চক্রটি গ্রাহকদের ফোন দেয় বলে কর্মকর্তারা জানান।
গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ সাংবাদিকদের বলেন, “মাগুরায় কয়েকটি চক্রের মধ্যে মিঠুন ও হামিদুল একই চক্রের সদস্য। তাদের মধ্যে হামিদুল মোল্লার কাজ বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে বিকাশ নম্বর সংগ্রহ করা।
প্রতি মাসের শুরুতে সে চট্টগ্রাম চলে আসে। ইপিজেড এলাকার বিকাশ এজেন্টের দোকানে টাকা তোলা কিংবা পাঠানোর নাম করে বিভিন্ন নম্বর সংগ্রহ করে।
আগে থেকেই হামিদুল মোবাইলের ভিডিও অন করে রাখেন জানিয়ে তিনি বলেন, এজেন্টের সাথে কথা বলার সময় সে টেবিলে রাখা নম্বর নিবন্ধনের খাতাটি ভিডিও করে নেন। দোকান থেকে বের হয়েই সেটি মাগুরায় পাঠিয়ে দেন।
প্রতিটি এজেন্টের দোকানের নিবন্ধন বই ভিডিও করে পাঠানোর বিনিময়ে ১০০ টাকা করে পায়।
এডিসি রউফ জানান, চট্টগ্রামে আসার আগে হামিদুল কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী ও ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ইপিজেড এলাকা বেছে নেয়ার কারণ মাসের শুরুতে শ্রমিকরা বাড়িতে টাকা পাঠান। এদের ফাঁদে ফেলা সহজ।
নম্বর সংগ্রহের পর মাগুরা থেকে চক্রটি কারও টাকা হাতিয়ে নিতে পারলে, তা অন্য জেলা থেকে তাদের সদস্যদের মাধ্যমে তুলে নেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা রউফ জানান, হামিদুলকে আটকের পর তার কাছ থেকে বিভিন্ন এজেন্টের নিবন্ধন বইয়ের ৩৬টি ভিডিও পাওয়া গেছে।
ভিডিও সহযোগীদের কাছে পাঠানোর পরপরই মোবাইল থেকে সেগুলো মুছে ফেলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছে হামিদুল।
তার জব্দ করা ফোন সেটটি ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠানোর কথা উল্লেখ করে এডিসি রউফ বলেন, তারা কতদিন ধরে কী পরিমাণ মানুষের কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তা জানা দরকার।
এদিকে সোমবার হামিদুল মহানগর হাকিম শফিউল আলমের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ওসমান গণি।
এছাড়া মিঠুন বালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়।
আদালত সেটি শুনানির জন্য রেখে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।