গৃহবর্জ্য সংগ্রহে বড় বাণিজ্য

এইমাত্র জাতীয়

দুই সিটির পদক্ষেপ জানতে চান হাইকোর্ট


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানী ঢাকায় গৃহবর্জ্য সংগ্রহে বড় বাণিজ্য করে যাচ্ছে একশ্রেণীর অসৎ ব্যক্তিরা। প্রায় প্রতিটি বাসা বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। এদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আইন অনুসারে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা তিনমাসের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বুধবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
রিটকারি আইনজীবী সৈয়দ মহিদুল কবির আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের গৃহবর্জ্য ও বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, পয়ঃনিষ্কাশন, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব বিল্ডিং, সুইপার প্যাসেসসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ মহানগরী। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে মানুষজনের তৈরি আবর্জনাও। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মূলত একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় এবং ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং কারণ এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের মোট বর্জ্যের শতকরা ৩৭ ভাগ উৎপাদিত হয় রাজধানী ঢাকায়। তাই এ শহরের ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ করে তা আবর্জনার স্তূপে পাঠিয়ে দেয়ার পরিবর্তে প্রয়োজন পরিকল্পিত সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডোর) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার একমাস পর উৎপাদিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় প্রায় তিন হাজার ৭৬ টন যেখানে সার্জিক্যাল মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস এবং স্যানিটাইজারের বোতল এই বর্জ্যের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া এখানে ত্রাণ বিতরণে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ব্যাগও ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে পলিথিন ব্যাগের বর্জ্য পাঁচ হাজার ৭৯৬ টন, পলিথিন হ্যান্ড গ্লাভস তিন হাজার ৩৯ টন, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস দুই হাজার ৮৩৮ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক এক হাজার ৫৯২ টন এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ৯০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করেছে। ঢাকায় সর্বোচ্চ এক হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভসের বর্জ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া রাজধানীতে পলিথিন হ্যান্ডগ্লাভস ৬০২ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক ৪৪৭ টন, পলিথিন ব্যাগ ৪৪৩ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ২৭০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে।
জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রতিটি হোল্ডিং থেকে বর্জ্য অপসারণ বাবদ ১০০ টাকা করে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও এটা মানছে না ওই বর্জ্য সংগ্রহের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান। দোকানপাট, মার্কেট, সরকারি অফিস ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আলোচনা করে মূল্য নির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয় ইজারাদারদের। এ সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ইজারাদাররা। তারা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করছে। এ ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। ডিএসসিসির চানখাঁরপুল লেনের বাসিন্দা আহমেদ কবীর বলেন, হোল্ডিং প্রতি ১০০ টাকা ধার্য থাকলেও এ এলাকার বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘বন্ধন ক্লিন’ সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে।
অন্যদিকে ডিএনসিসি এখনো ফি নির্ধারণ করতে পারেনি। অবিভক্ত সিটি করপোরেশন ২০০৯ সালে প্রতি হোল্ডিং থেকে ৩০ টাকা করে আদায়ের নির্দেশ দেয়। ডিএনসিসি গঠিত হওয়ার পর প্রয়াত মেয়র মো. আনিসুল হক সেটা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করার বিষয়ে বোর্ড সভায় প্রস্তাব অনুমোদন করেন। পরে তা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। এরপর সেটা আর চূড়ান্ত হয়নি। এক্ষেত্রে আগের ৩০ টাকা ফি বাস্তবসম্মত না হওয়ায় আবর্জনা সংগ্রহের সঙ্গে জড়িতরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ফি আদায় করে চলেছে। ডিএনসিসির অনেক এলাকার বাসা-বাড়ি থেকে ৮০-১০০ টাকা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ১৫০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। তবে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা ও লালমাটিয়া এলাকায় এটা ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। আর দোকানপাট, সুপারশপ, মার্কেট থেকে ইচ্ছামতো ফি আদায় করা হচ্ছে বলে স্বয়ং ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ তথ্য দিচ্ছে।
আরো জানা যায়, ডিএসসিসি এলাকার বর্জ্য সংগ্রহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ‘ঢাকা ওয়েস্ট কালেকশন ফাউন্ডেশন’। এ সংগঠনের সদস্য ৪৫০টি প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রায় ৪ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। গত বছরের কোরবানি ঈদের আগে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসা অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন ৭৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৫টি ওয়ার্ডের বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ডিএসসিসির বর্তমান হোল্ডিং সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার। আর ট্রেড লাইসেন্স সংখ্যা ২ লাখ ৩১ হাজার। এ সংখ্যা অনুযায়ী ১০০ টাকা বর্জ্য সংগ্রহ ফি ধরলে মাসিক হিসাব দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বছরে এর পরিমাণ হয় ৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর ডিএনসিসির হোল্ডিং সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার। আর ট্রেড লাইসেন্স সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজার। এ সংখ্যা অনুযায়ী ১০০ টাকা করে বর্জ্য ফি ধরলে মাসিক হিসাব দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা। যেটা বার্ষিক পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ বছরে অন্তত ১১৮ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ কার্যক্রম যথাযথভাবে বিধিমালা অনুসরণ করে করলেও ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকার বাজার এটা। এ বাজারে বিশৃঙ্খলা থাকায় অসাধু ব্যক্তিরা এখান থেকে আরো বেশি টাকা তুলে নিচ্ছেন। এতে জনগণ ও সিটি করপোরেশন উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের বিল মাসে ১শ’ টাকার বেশি আদায় করা যাবে না বলে প্রাথমিক বর্জ্য সেবা সংগ্রহকারীদেরকে (পিসিএসপি) নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
তাপস বলেন, নতুন আঙ্গিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট হারে আমরা মাসিক চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছি। কোথাও এই হারে ব্যত্যয় করা যাবে না। কোনো পিসিএসপি বাসা-বাড়ি থেকে ১০০ টাকার বেশি চার্জ আদায় করতে পারবেন না।
এদিকে বর্জ্যকে সম্পদ উল্লেখ করে জাতীয় অধ্যাপক ও বুয়েট অ্যালামনাইয়ের সভাপতি জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, দৈনিক যে পরিমাণ বর্জ্য হয়, তার পুরোটা সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে না। অসংগৃহীত বর্জ্য খাল, নালায় ফেলা হচ্ছে। বর্জ্য রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা) করার পরিমাণও কম। যেসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী বর্জ্য সংগ্রহ করেন, তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিও উপেক্ষিত।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, লোকজন খালকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে। ডাব, কোমল পানীয় পান করার প্লাস্টিক স্ট্র দিয়ে নালা ভরে থাকছে। শহরের সবাই নাগরিক, কিন্তু সুনাগরিক কতজন? শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।