মা-বাবা ও ছোটবোন খুনে অনুতপ্ত নন ঘাতক মুন

অপরাধ এইমাত্র

‘ক্রাইম প্যাট্রোল ও মোবাইল গেম’ দেখে ৬ মাস আগে থেকে হত্যার পরিকল্পনা


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : কদমতলীতে মা-বাবা ও ছোটবোনসহ ট্রিপল খুনের প্রধান ঘাতক বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হননি। তার স্বামীর সঙ্গে ছোটবোনের পরকীয়া ও পবিারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই এই খুন করা হয়েছে। তিনজনকে একাই খুন করেছেন এবং হত্যাকান্ডে অন্য কেউ জড়িত নন। এই খুনের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধানও হয়েছে বলে ঘাতক মেহজাবিন ইসলাম মুন মনে করছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মা-বাবা ও বোনকে খুনের মামলায় গ্রেফতারকৃত মুন ভারতীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’-এর মনোযোগী দর্শক ছিলেন। অপরাধবিষয়ক ওই অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। সেইসঙ্গে একটি মোবাইল ফোনে অনলাইন গেমেও আসক্ত ছিলেন। অর্থের বিনিময়ে সেই গেমটি খেলতেন মুন। ওই গেমের নায়ক নানা কৌশলে শত্রুদের মেরে ফেলতো।আবার অজ্ঞান করে হত্যার কৌশল জানতে অনলাইনে প্রচুর অনুসন্ধান চালিয়েছে মুন। এই ক্রাইম প্যাট্রোল দেখা, মোবাইল গেম খেলা ও অনলাইন অনুসন্ধানের মাধ্যমে পরিবারের তিন সদস্যকে হত্যার পরিকল্পনা করে ছিল মেহজাবিন ইসলাম মুন। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এসব বিষযে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন বলে জানা গেছে।
সুত্র জানায়, গত ছয় মাস আগে থেকেই ঘাতক তার মা-বাবা ও ছোট বোনকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকেই বিভিন্ন ওষুধের দোকান থেকে একটি-দুটি করে ঘুমের ট্যাবলেট জোগার করে। সেই ট্যাবলেটই গত শুক্রবার রাতে গুঁড়া করে চা, কফি ও পানিতে মিশিয়ে তিনজনকে খেতে দেয়। আর তাদের সঙ্গে তার স্বামী ও শিশু সন্তানকে সামান্য পরিমান দিয়েছিল। যাতে পরিবারের সদস্যরা কোন প্রকার সন্দেহ করতে না পরেন। আর সেগুলো খেয়ে সবাই অচেতন হলে শ্বাসরোধে তিনজনকে হত্যা করা হয়। গত দুই মাস আগেও তরমুজের জুসে ঘুমের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পরিবারের সদস্যদের হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল মুন।
রাজধানীর মুরাদপুরের লাল মিয়া সরকার রোডের বাসায় তিন খুনের ঘটনায় গ্রেফতারৃকত মুন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছে। গত শনিবার রাতে তার বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় হত্যা মামলা করেন তার চাচা সাখাওয়াত হোসেন। মামলায় তার স্বামী শফিকুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে। মুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। আর চিকিৎসাধীন শফিকুলকেও পুলিশ গ্রেফতার দেখিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঘাতক মেহজাবিন ইসলাম মুন লেখাপড়ায় মেধাবী ছিলেন।এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ ৫ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার মা মৌসুমি দুই মেয়েকে অসামাজিক কার্যকলাপে বাধ্য করা, এমনকি পরীক্ষা চলা অবস্থায়ও টাকার জন্য তাকে অন্যের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করতো। এজন্য এসএসসিতে জিপিএ ৪.৮ পান মুন। আর এজন্যও তার মায়ের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল।
সুত্র জানায়, মায়ের নির্যাতন থেকে বাঁচাতে তার বাবা কোনো ভূমিকা না রাখায় তাকেউ খুনের পরিকল্পনা নেয় মুন। আর তার ছোট বোন মোহিনীর সঙ্গে তার স্বামী শফিকুল অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় তাকেও খুনের পারিকল্পা নেয়। এজন্য দুই মাস আগে মুন মা-বাবা-বোনকে হত্যার চেষ্টা চালায়। সেদিন ঘুমের ওষুধ মেশানো জুস খেয়ে অচেতন হলে তার বাবা মাসুন ডায়াবেটিস রোগী হওয়ায় তিনি খেতে রাজি হননি। ফলে তার পরিকল্পনা সফল হয়নি। ওই দিন ৪০টি ট্যাবলেট গুড়া করে মিশিয়ে খাওয়াইয়ে ছিল।
স্থানীয়রা জানায়, পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে জটিলতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বিয়ের আগে আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক মুনকে প্রাইভেট পড়াতেন। তখন ছাত্রীর সঙ্গে তার প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক হয়। পরে গৃহশিক্ষক ছাত্রীর মা মৌসুমীর সঙ্গেও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। আর দু’জনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ভিডিও করে রেখেছিলেন আমিনুল। ওই ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে তিনি মা-মেয়েকে জিম্মি করে ভোগ করে আসছিল। এমনকি তিনি মুনের ছোট বোন মোহিনী ও তার এক আত্মীয়ের সঙ্গেও অবৈধ সম্পর্ক করেছিল। একপর্যায়ে আমিনুলকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়।
অপরদিকে মুন তার মা-বাবা ও ছোটবোনকে খুনের দায় স্বীকার করলেও ঘটনাটি তার পক্ষে একা ঘটানো সম্ভব নয় বলে স্বজনরা মনে করছেন। তার খালা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, গৃহশিক্ষক আমিনুল হত্যা মামলা নিষ্পত্তির জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ২০ লাখ টাকা চেয়ে আসছিলেন শফিকুল। সেইসঙ্গে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছিলেন। টাকা না দেওয়ায় তিনি বিভিন্নভাবে স্ত্রী ও শাশুড়িকে নির্যাতন করতেন।
মুনের খালা ইয়াসমিনের দাবি, ‘তিনজনকে হত্যা করেছে শফিকুল নিজেই। তাকে যাতে কেউ সন্দেহ না করেন, সেজন্য সে ওষুধ খেয়ে অসুস্থতার ভান করে। নিজে হত্যার পর সে মেহজাবিনকে দিয়ে ৯৯৯-এ ফোন দেয়ায়।
মুনের খালা শিউলি বলেছেন, মুনের সঙ্গে বিয়ের পর জান্নাতুলকে ব্ল্যাকমেইল করে শারীরিক সম্পর্ক করে শফিকুল। বিষয়টি জানান পর জান্নাতুলকে অনেক বুঝিয়েছি। পরে ওই পথ থেকে সরে যায়।কিন্তু বিষয়টি মুন জেনে ফেলায় শফিকুল নিজের মেয়েকে মেরে ফেলার ভয় দেখাত। একপর্যায়ে সম্পত্তি দখলের জন্য শফিকুল জান্নাতুলকে স্ত্রী হিসেবে দাবি করে। জান্নাতুলের বিয়ের কোনো প্রস্তাব এলে বিয়ে ভেঙে দিত শফিকুল।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মুন একাই তিনজনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।তবে তার স্বজনরা বলছেন, অর্থ ও সম্পত্তির জন্য এই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। এতে শফিকুলও জড়িত।এবিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার স্বামীকেও রিমান্ডে নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, মাসুদ রানা (৫০), তার স্ত্রী মৌসুমী আক্তার (৪৫) এবং তাদের ছোট মেয়ে জান্নাতুল (২০) কে খুন করা হয়। সেখান থেকে অচেতন অবস্থায় মুনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ও মেয়ে তৃপ্তিকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।শনিবার সকালে নিজেদের বাসা থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে তিনজনকে হত্যার কথা জানান মুন। পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে তার বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম ও ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে। ঘাতক মুন চার দিনের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন।