এডিসের লার্ভায় সয়লাব রাজধানী

রাজধানী স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু বেড়েছে ৬০ গুণ!


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানীর প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকায় এডিসের ঘনত্ব আশঙ্কাজনক। মৌসুমি জরিপের দুই তৃতীয়াংশ শেষে এমনটাই জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যেখানে বর্ষা শুরুর আগের জরিপে এই হার ছিল পঁচিশ ভাগের কম। বর্ষার ধরন আর অসচেতনতাকে এর জন্য দায়ী করছেন তারা।
ডেঙ্গু বাহক এডিসের ঘনত্ব কেমন তা জানতে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ও এর আগে পরে তিন দফায় জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতি বর্ষাতেও শুরু হয়েছে মৌসুমি জরিপ। মিলছে এডিসের লার্ভা।
জরিপে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে এমন এক বাড়ির মালিক বলেন, অবশ্যই এটা আমাদের ভুল। বাড়ির কেয়ারটেকার নাই, সেজন্য তো এভাবে ফেলে রাখা ঠিক হয়নি আমাদের। নিজেদের পরিষ্কার করা উচিত ছিল।
জরিপকারীরা বলছেন, প্রধানত পরিত্যক্ত টায়ার ও ড্রামের জমে থাকা পানির মধ্যেই এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আর কনস্ট্রাকশন এলাকায় তো সব সময় পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯৬টি ওয়ার্ডে একটি করে এলাকা। উত্তরা আর ধানমন্ডিতে দুটি এলাকা নিয়ে দশ দিনে ১০০টি এলাকায় হয় এই জরিপ। প্রতিটি এলাকায় আবার ৩০টি বাড়ি দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্ণয় করে সেখানে খোঁজা হয় লার্ভা। সেখান থেকে ব্রটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি পেলেই তাকে আশঙ্কাজনক হিসেবে ধরা হয়। প্রতি এলাকায় পাওয়া ১০০টি, পাত্র, কিংবা স্বচ্ছ পানি জমে আছে এমন জায়গায় ২০টিতে এডিসের লার্ভা মিললে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এবারের বর্ষায় সাত দিনের জরিপ শেষে অধিদপ্তর বলছে প্রায় ৭০ ভাগ এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। বর্ষার আগের জরিপে যা ছিল প্রায় ২৫ ভাগ এলাকায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান বলেন, গত সাত দিনে আমরা ৭০টি ওয়ার্ডে জরিপ করেছি। এর মধ্যে ৭০ ভাগ এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। যে এডিস মশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু হওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।
অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে এবারের বর্ষার ধরণ আর অসচেতনয়ই বাড়ছে এডিসের প্রকোপ, বাড়ছে ডেঙ্গু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিপিএম (ডেঙ্গু) ডা. আফসানা আলমগীর খান বলেন, দুই-তিন দিন ধরে বৃষ্টি নেই, আবার দুই-তিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। যদি এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণ খোঁজা হয়, তাহলে এটাও একটা।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আরও জনসম্পৃক্তরা নিশ্চিত করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবার শঙ্কা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
ডেঙ্গু বেড়েছে ৬০ গুণ! : জুন থেকে সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর মৌসুম। গতবছরের জুন ও জুলাই মাসের তুলনায় ২০২১ সালের দুই মাসে মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ৬০ গুণ! আবার শুধু আগস্টের হিসাব ধরলে সেটা ছাড়িয়ে যায় ৭০ গুণ। আর এমনটা যে ঘটবে, সেটা আগেই বলেছিলেন কীটতত্ত্ববিদরা। গত জুনেই তারা বলেছিলেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু বেশ কয়েকগুণ বাড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতবছরের জুনে ২০ জন, জুলাইয়ে ২৩ জন, আগস্টে ৬৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। আর এবারের আগস্টেই গড়ে প্রতিদিন আক্রান্ত হয়েছেন আড়াই শ’ জন করে। চলতি বছরের জুনে ২৭২, জুলাইয়ে দুই হাজার ২৮৬ জন এবং আগস্টের প্রথম চার দিনে এক হাজার ২৫ জন আক্রান্ত হন।
চলতি বছর জুন থেকে আগস্টের প্রথম চারদিন পর্যন্ত মোট ৬৫ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ৫৮৩ জন। গতবছরের আগস্টের প্রথম চার দিন আক্রান্ত ছিল ৫১ জন। সেই হিসাবে চলতি বছরের এই সময়ে রোগী বেড়েছে ৭০ গুণ।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘চলতি বছরের জুনের শুরু থেকেই বলে আসছি ডেঙ্গু বাড়বে। কেউ কান দেয়নি। উত্তরের মেয়র মাঠে কিছুটা সরব ছিলেন। তারা কিছু কাজ করেছেন। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ডেঙ্গুর যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি সেটা পুরোপুরি নয়। রোগী আরও বেশি। সব হাসপাতাল কিন্তু তথ্য দেয় না। করোনার ক্ষেত্রে যারা শুধু টেস্ট করে তাদের হিসাবটা আসে। ডেঙ্গুতেও তাই ঘটছে।’
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সিটি করপোরেশনের অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কমিটি করতে হবে। প্রতিটি কমিটিতে একজন লার্ভিসাইডিং স্প্রেম্যান ও একজন অ্যাডাল্টিসাইডিং স্প্রেম্যান দিতে হবে। এদের সঙ্গে একজন ক্লিনার রাখতে হবে। নেতৃত্ব দেবেন জনপ্রতিনিধিরা। একযোগে কাজটি করতে হবে।’
কবিরুল বাশার আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের সমস্যা হলো পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলেই তারা কোমর বেঁধে নামে। আমরা পূর্বাভাস দিলে ব্যবস্থা নেয় না।’
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এই মুহূর্তে প্রয়োজন উড়ন্ত মশা মারা। বেশি বেশি ফগিং করতে হবে। লার্ভা পরে মারতে হবে। কারণ উড়ন্ত মশাগুলো তো আক্রান্ত করছে। যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে সেসব এলাকায় ওষুধ ছিটাতে হবে আগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানগুলোতে লক্ষ্য করছি ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে জরিমানা করছে। কিন্তু লার্ভাগুলো ধ্বংস করে আসছে না।’
এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের শুরুতে বছরের অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে ঢাকায় কিউল্যাক্স মশা বেড়েছে চার গুণ। আগে যেখানে প্রতি ডিপ-এ (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) মশার ঘনত্ব ছিল ১০-১৫টি, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে তা ৫০টিরও বেশি দেখা যায়।
মশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকেই দায়ী করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, বছরজুড়ে যেখানে মশকনিধন চলার কথা, সেখানে ডেঙ্গু কমার পর দুই সিটি করপোরেশনে কোনও কাজই হয়নি। মশার ওষুধ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন খোদ কাউন্সিলররাই।
বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত সহকারী জানান, ‘স্যার মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন না।’
উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন অভিযানের পাশাপাশি ভ্রম্যমাণ আদালত ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষকে সচেতন করে আসছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছি প্রতি শনিবার তারা যেন সকালে অন্তত ১০ মিনিট সময় নিয়ে বাসার জলাবদ্ধ ও অপরিচ্ছন্ন স্থানগুলো পরিষ্কার করেন। তাতেও আশা করি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে।’