সরকারি ৫৪ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ১৭৭০ কোটি টাকা!

অর্থনীতি এইমাত্র

বিশেষ প্রতিবেদক : সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি ৫ লাখ টাকা। গত বছরের নভেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, র্দীঘ সময় ধরে বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সেবার মান বৃদ্ধি ও উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি আনতে পারছে না। যদিও বকেয়া আদায়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তাগিদ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এদিকে, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করলে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে বরাদ্দ বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিল বকেয়া থাকার তালিকায় স্থানীয় সরকার বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, র্দুযোগ, নৌ পরিবহন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এমনকি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগও রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বিল পরিশোধের জন্য একাধিক চিঠি এবং তাগাদা দেওয়া হলেও এ ব্যাপারে তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এবং নর্দান ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো) এই ছয়টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিতরণ করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত এবং বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া মোট ৬ হাজার ৭৬৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সরকারের ৫৪ প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ৭৬৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। টাকার অংকে বেসরকারি খাতে বকেয়া বিলের পরিমান বেশি হলেও সময়ের হিসাবে সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাকির খাতা বেশ র্দীঘ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে দুই থেকে তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কয়েক বছরের পুরনো বিলও রয়েছে।
সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলিয়ে মোট ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে- স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে। তাদের মোট বকেয়া ৮৬৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাওনা ২৫০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাছে ১১৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা, গৃহায়ন ও গণর্পূত মন্ত্রণালয়ের কাছে ৯৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগের কাছে ৮১ কোটি ৮ লাখ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৪১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কাছে ৩৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কাছে ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বিদ্যু বিভাগের।
এর বাইরেও রয়েছে- খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ কোটি ৬৮ লাখ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের কাছে ২ কোটি ৬৭ লাখ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ৭ কোটি নয় লাখ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ কোটি ৭৩ লাখ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কাছে ৪ কোটি ৪৫ লাখ, সেতু বিভাগের কাছে ৭৯ লাখ টাকা, পরিবেশ বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ কোটি ১৬ লাখ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৮ কোটি ৯ লাখ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২ কোটি ৭৩ লাখ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে ৯৬ লাখ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের কাছে ৭ কোটি ২ লাখ, সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে ৫ কোটি৫২ লাখ, শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে ১২ কোটি ৬৫ লাখ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪ কোটি ৪২ লাখ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে ২০ লাখ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে ২৮ কোটি ৬ লাখ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ ১১ কোটি ৬২ লাখ, পরিকল্পনা বিভাগের ৪ লাখ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাছে ৩০ লাখ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কাছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পাওনা বিদ্যুৎ বিভাগের।
এছাড়াও বিদ্যুৎ বিভাগের নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪ কোটি ৫ লাখ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৫৬ লাখ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে ৯০ লাখ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ কোটি ৩২ লাখ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ কোটি ৯৬ লাখ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ কোটি ৮৬ লাখ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে ৩২ লাখ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৯ কোটি ৫৮ লাখ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮৭ লাখ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৫ কোটি ৩২ লাখ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, অর্থ বিভাগের কাছে ২ কোটি ৮১ লাখ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে ১ কোটি ৩৯ লাখ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কাছে ৭ কোটি ৭৬ লাখ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে ৪৯ লাখ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮ লাখ, আইন ও বিচার বিভাগের কাছে ৬ কোটি ২৬ লাখ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের কাছে ৮৬ লাখ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৯ লাখ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের কাছে ১৮ কোটি ৭৩ লাখ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের কাছে ১০ লাখ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে ৭৯ লাখ, জাতীয় সংসদ সচিবালয়র কাছে ২১ লাখ, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে ৬ কোটি ৭৩ লাখ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাছে ১৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
এই চিত্র বলে দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি বকেয়া স্থানীয় সরকারের বিভাগে ৮৭০ কোটি টাকা। আর সবচেয়ে কম বকেয়া পরিকল্পনা বিভাগের মাত্র ৪ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘শুধু পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনই না ইউনিয়ন পরিষদও বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখেছে। আমরা সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে একটা বৈঠক করেছি এবং বলেছি যদি কোনো পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ বিদ্যুৎ বিল বাকি রাখে তাদের আমরা কোনো বরাদ্দ দেব না। যদি এসব প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকে তাহলে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিতে পারে। প্রয়োজনের তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। যারা বকেয়া বিল দেয়নি- বিদ্যুৎ বিভাগ যদি তালিকা দেয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তাদের বরাদ্দ বন্ধ করে দেব। আমরা এরই মধ্যে এ ধরনের একটা নির্দেশনা জারি করেছি।’
এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়ার পরিমাণ বেশি হলেও তারা অপেক্ষাকৃত কম সময় বকেয়া ধরে রাখছে। তারা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিলিং মাসের বাইরে এক সমতুল্য মাসের কম সময়ের বিল বাকি। যে কারণে বেসরকারি খাতের বকেয়া বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপরে তেমন চাপ সৃষ্টি করছে না। কিন্তু সরকারি, আধা-সরকারি আর স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েক বছরের বিল বকেয়া রয়েছে। যে কারণে একটি বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা অনুবিভাগ পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিল বকেয়া থাকা নতুন নয়। দেশের বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির পথে বড় বাধা বকেয়া বিল। তবে এই পরিস্থিতির এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। এক সময় সারা বাংলাদেশে বিল হতো মাসে ৩ হাজার কোটি টাকা। এই ছয় মাসের সমমানের বকেয়া বিলই বকেয়া পড়ে থাকতো। যেমন মাসে বিল ৩ হাজার কোটি টাকা হলে ১৮ হাজার কোটি টাকা বকেয়া থাকতো। এখন তা নেমে এসেছে ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকার মধ্যে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি যে, তারা যখন বাজেট দেয় তখন ইউলিটিসের বাজেট যেন আলাদা থাকে। সেটা যেন ওদের কাছে না দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে সরাসরি দেওয়ার নিয়ম করে দেয়। আমরা বকেয়া চেয়ে সব প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়েছি। যদি না মানে তবে ভবিষ্যতে হয়তো ওই পদ্ধতিতেই যেতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনছি। যার কাজ চলমান। যদি সকল গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা যায়, তাহলে আর বকেয়ার ঝামেলা থাকবে না। কারন প্রিপেইডে গ্রাহক আগে পেমেন্ট করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে।’
সূত্র জানায়, সরকারি, আধা-সরকারি খাতের বকেয়া থাকা বিদ্যুৎ বিল কমাতে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জোরেশোরে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বকেয়া বিল আদায়ে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিল পরিশোধে ডিও লেটার ইস্যু করা এবং টাস্কফোর্সের ঝটিকা অভিযানের কারণে ওই সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিপুল পরিমাণে বকেয়া বিল আদায় করা সম্ভব হয়।


বিজ্ঞাপন