গণটিকায় দ্বিতীয় দিনেও গণভোগান্তি

এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

*ভোররাতে সিরিয়ালে দাঁড়িয়েও মিলছে না টিকা
*টিকা নিতে এসে মারধরের শিকার মা-ছেলে


বিজ্ঞাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : গণটিকা কার্যক্রমের দ্বিতীয় দিনে সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। ফলে ভোগান্তিও বেড়েছে প্রথম দিনের তুলনায়। মূলত টিকার সংখ্যা সীমিত হওয়ায় অনেকেই টিকা কার্ড পাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের। তুলনামূলক ভিড় বেড়েছে রাজধানীতে।
রোববার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন টিকাকেন্দ্রে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। সকাল ৯টায় টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ৭টা থেকেই লোকজনকে আসতে দেখা যায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেও বাড়তে থাকে ভিড়।
রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের মিন্টু সরণি সংলগ্ন ২১ নম্বর সড়কের সূর্যের হাসি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এসেছেন মোহাম্মদ শাহীন আলম। তিনি বলেন, সকাল ৮টার মধ্যে চলে এসেছি। শুনেছি শানিবার খুব ভিড় ছিল। এজন্য রোববার আগে এসেছি। তবু সেই ভিড়ের মধ্যে পড়লাম।
রাজধানীর প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের চিত্র একই। অনেক কেন্দ্রে দেখা গেছে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, কাউন্সিলর ও তার অনুসারীরা কেন্দ্রের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। তবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের চিত্র কোথাও পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষরা জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হন। দায়িত্বরতরা জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার, বয়স, নামসহ কয়েকটি তথ্য টিকা কার্ডে উল্লেখ করে একটি কার্ড দিয়ে দিচ্ছেন। সেটা দেখালে টিকা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে অনেকেই জানেন না কার্ড সংগ্রহের নিয়ম। তারা শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। এমনই একজন বীরেন দাস। তিনি বলেন, আমরা তো খবরে দেখলাম, ভোটার কার্ড নিয়া এলেই টিকা দিবে। এখানে দেখছি উল্টো নিয়ম। টিকা কার্ড আবার কোথা থেকে নেব?
এ কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৯টায়ও টিকা কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি কর্মীরা। পুরুষ ও নারীরা আলাদা দুটি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নারীদের সংখ্যাই ছিল বেশি।
টিকাদান কার্যক্রমের সার্বিক দায়িত্ব পালনকারী সূর্যের হাসি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তা রনি আহমেদ জানান, প্রথম দিন তাদের সাড়ে তিনশর মতো টিকা দেয়া হয়েছে। তবে মানুষের চাপ সামলানো যাচ্ছে না। এ জন্য যারা এসেছেন তাদের রেজিস্ট্রেশন করে রাখা হয়েছে। আজ তাদের টিকা দেয়া হবে।
গণটিকা কর্মসূচির প্রথম দিন ২৭ লাখের বেশি মানুষকে দেয়া হয়েছে প্রথম ডোজ। এর মধ্যে ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৯৩৮ জন পুরুষ এবং ১২ লাখ ৬৮ হাজার ২৩৬ জন নারী। টিকা নেয়াদের মধ্যে চীনের সিনোফার্মের টিকা নিয়েছেন ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৫১ জন নারী ও পুরুষ। অন্যদিকে মডার্নার টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭২১ জন।
এদিন চাহিদা অনুযায়ী টিকার বরাদ্দ না থাকায় অনেক মানুষকে ফেরত যেতে হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, দেশে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ ৭২ হাজার ৯৬৯ জন প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৫৮ লাখ ১৭ হাজার ৩৩ জন সিনোফার্মের টিকা নিয়েছেন। আর মডার্না নিয়েছেন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬১৮ জন। শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত একযোগে সারাদেশে গণটিকার ক্যাম্পেইন শুরু হয়।
ভোররাতে এসে সিরিয়ালে দাঁড়িয়েও মিলছে না টিকা : রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডার পূর্বাঞ্চল সড়কের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দ্বিতীয়দিনের মতো চলছে গণটিকাদান কর্মসূচি। ওই কেন্দ্রে ৩৫০ জনকে টিকা দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল। সেই অনুযায়ী পুরুষ ও নারীদের দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে সিরিয়াল ধরে পর্যায়ক্রমে সকাল ১০টার দিকে টিকা দেয়া শুরু হয়।
টিকা নিতে রোববার ভোররাতে কেন্দ্রে এসে সিরিয়ালে দাঁড়ান এলাকার বাসিন্দা সদরুল ইসলাম। দ্বিতীয়দিনে টিকাদান শুরুর সময়ে পুরুষদের লাইনে তার সিরিয়াল নম্বর ছিল ২৭। তবুও টিকা না নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে তাকে।
সদরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ফজরের নামাজের পরই টিকা নিতে কেন্দ্রে এসেছি। তখন ২৬ জনের পেছনে ছিলাম। আমার সিরিয়াল নম্বর ছিল ২৭-এ। যদি সাড়ে তিনশো’ টিকা দেয়া হয়, তবে আমাদের লাইন থেকে ১৭৫ সিরিয়াল পর্যন্ত টিকা পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার সিরিয়াল আসার আগেই ভেতর থেকে জানানো হচ্ছে- টিকা শেষ।’
নিজের পায়ে অপারেশন করায় অসুস্থ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অপারেশনের রোগী। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমরা কী স্বাধীন দেশে বাস করি না।’
সদরুলের সামনে সিরিয়ালে থাকা টিকা নিতে আসা আরেকজন বলেন, ‘ভাই কী বলব, আমাদের ভাগ্য খারাপ। ভাত পেয়েও খেতে পারি না, কাউয়ায় খেয়ে যায়! এই টিকা নেয়ার জন্য রাতে ঘুমাতে পারিনি, চেহারাটা একটু দেখেন।’
শুধু এই দু’জন নয়, শত শত মানুষ টিকা নিতে ভোরে এসে সিরিয়ালে দাঁড়িয়েও টিকা না পেয়ে এমন ক্ষোভ জানিয়েছেন।
তাদের অভিযোগ—সিরিয়ালে দাঁড়ানোদের টিকা না দিয়ে প্রভাবশালীরা নিজেদের ‘কমিশনারের লোক’ পরিচয় দিয়ে পরে এসেও আগে টিকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে সিরিয়ালে দাঁড়ানো মানুষ টিকা পাচ্ছেন না। টিকাদানেও স্বজনপ্রীতি হচ্ছে।
রোববার সকালে সরেজমিন পূর্বাঞ্চল সড়কের ওই প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা গেছে, বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত মানুষ টিকা নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেন্দ্রে প্রথম ডোজের ৩৫০টি টিকা বরাদ্দ বরাদ্দ থাকলেও দীর্ঘ লাইনে এক হাজারের বেশি নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অধিকাংশই ফজরের নামাজের পরপরই কেন্দ্রে এসেছেন বলে জানিয়েছেন।
পুরুষ ও নারীদের আলাদা দুই লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে ডেকে নিয়ে টিকা কার্ড নিয়ে টিকা দেয়া হচ্ছে। তবে সিরিয়ালে দাঁড়ানো মানুষেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও স্কুলের মূল গেটের নাগাল পাচ্ছেন না।
ভিড় ঠেলে লাইনে দাঁড়িয়ে যারা টিকা পাচ্ছেন, তারা নিজেদের অনেকটা সৌভাগ্যবান মনে করছেন। তাদেরই একজন সোমা বেগম।
টিকা নিয়ে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ফজরের আজানের আগে এসে দাঁড়িয়েছি। নারীদের লাইনে আমার সিরিয়াল নম্বর ছিল ৭০। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল- আমি ভেতরে যেতে পারব না। পুলিশের একজন সদস্যের সহযোগিতায় আমি ভেতরে ঢুকতে পেরেছি।’
সোমা বেগম আরও বলেন, ‘কষ্ট করে ভেতরে ঢুকলেও সেখানে সবকিছুতে বিশৃঙ্খলা। নিচতলায় কোনো নিয়ম নাই। সেখানে গিয়ে হুড়োহুড়িতে আমার গলায় ওড়না প্যাচিয়ে যায়। প্রায় মরতে বসেছিলাম। তবে স্কুলের দ্বিতীয়তলায় যেখানে টিকা দেয়া হচ্ছে, সেখানে কোনো সমস্যা নেই।’
দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার জন্য তাকে ৫ সেপ্টেম্বর আবার আসতে বলা হয়েছে বলে জানান সোমা বেগম।
টিকাকেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মো. সাইফুল, ‘টিকা নেয়ার জন্য ব্যাপক ভিড়। সামলানো মুশকিল হয়ে গেছে।’ তবে সিরিয়াল ছাড়া রাজনৈতিক পরিচয়ে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
পূর্বাঞ্চল সড়কের প্রাথমিক বিদ্যালয় টিকাকেন্দ্রের সুপারভাইজার মহসিন আলী বলেন, ‘বাইরে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি-না, সেটা আমরা জানি না। সিরিয়াল ধরে যারা ভেতরে আসছেন, তাদের নিবন্ধন করিয়ে টিকা দিয়ে কার্ড দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এই কেন্দ্রে ৩৫০টি প্রথম ডোজের টিকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ফলে লাইনে যত মানুষ এসেছেন, তাদের সবাইকে টিকা দেয়া আজ সম্ভব হবে না। তবে পর্যায়ক্রমে সবাই টিকা পাবেন।’
টিকা নিতে এসে মারধরের শিকার মা-ছেলে : পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে কোভিড-১৯ টিকা কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে মারধরের শিকার হয়েছেন মা-ছেলে। শনিবার দুপুরে উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের ফেলাবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
এতে একজন আহত হয়েছে। আহত ব্যক্তির নাম সোহাগ (৩২)। তার বাড়ি ওই ইউনিয়নের টুঙ্গিবাড়িয়া গ্রামে।
জানা গেছে, দুপুর ১টার দিকে ওই টিকা কেন্দ্রে টিকা দিতে যান সোহাগ ও তার মা। কেন্দ্রে লাইনে (সারিতে) দাঁড়াতে গেলে ফেলাবুনিয়া গ্রামের জুলহাস নামের এক ব্যক্তি তাদের বাঁধা দেয়। এনিয়ে সোহাগ ও জুলহাসের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি হয়। এর জেরে জুলহাস তার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সোহাগকে মারধর করে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মারধরে আহত সোহাগ বলেন, টিকা দিতে মাকে নিয়ে কেন্দ্রে গেলে জুলহাস লাইনে দাঁড়াতে বাঁধা দেয়। এনিয়ে আমাকে থাপ্পর দেয়, পরে আমিও তাকে থাপ্পর দেই। পরে সে লোকজন নিয়ে আমাকে মারছে। মাকেও মারছে, কিন্তু সে লজ্জ্বায় বলে না।
সে (জুলহাস) তার আত্মীয়-স্বজনরা যাতে টিকা আগে পায়, সে জন্য এই কাজ করছে। পরে আর আমরা টিকা দিতে পারিনি। আমি থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
বড়বাইশদিয়া পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ইলিয়াস মিয়া বলেন, কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে নাই। কেন্দ্রের বাহিরে একটু ঝামেলা হয়েছে শুনেছি।
এ ব্যাপারে রাঙ্গাবালী থানার ওসি দেওয়ান জগলুল হাসান বলেন, মহিলাদের লাইনে দাঁড়াতে গেলে স্বেচ্ছাসেবকরা ওই ব্যক্তিকে বাঁধা দিলে হাতাহাতি হয়। একজন এসে একটি অভিযোগ দিয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, সিপিপি লাঞ্ছিত হওয়ার বিষয়টি শুনেছি। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি।