ব্যবসায়ী মতিনকে হত্যা করে ঘটনা ভিন্ন দিকে ঘুরানোর চেষ্টা

নিজস্ব প্রতিনিধি : সকাল ১০ বেজে ১০ মিনিট তখন , সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার গুল্টাবাজার সংলগ্ন হাইস্কুল মাঠে কতিপয় ছেলেরা ক্রিকেট খেলছিল। হঠাৎ ক্রিকেট বলটি চলে যায় স্কুল সংলগ্ন টয়লেটের ওখানে।

করোনার কারণে স্কুল বন্ধ তাই টয়লেটে প্রবেশ করা সহজ ছিল না। অগত্যা একজন টয়লেটের ছাদে উঠলো লাফিয়ে। দেখা গেল ভিতরে একটি লাশ পড়ে আছে। তারপর খবর পেয়ে অনেকেই আসলো সেখানে।
লাশ সনাক্ত হল। লাশটি ছিল গুল্টা বাজারের ইলেট্রনিক্স পন্য ব্যবসায়ী এবং মোবাইল ফোন মেকার আঃ মতিনের।
গতরাত ১২ টার পরের দিকে (১৬/০৬/২০২১) তার মা যখন মতিনকে ফোন করে তখন সে জানিয়েছিল ” মা, আসছি, এই তো রওয়ানা করছি “।
কিন্তু তার আর বাড়িতে ফেরা হয়নি। ঘটনা শোনার পর লাশের কাছে ছুটে যায় থানা পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই। আলামত সংগ্রহ হল। মামলা হলো আজ্ঞাতনামা আসামী করে।
তাড়াশ থানার মামলা নং ১০ তাং ১৬/০৬/২০২১, ধারাঃ ৩০২/৩৪ দঃবিঃ। মামলা তদন্তের দ্বিতীয় দিনে থানার তদন্তকারী অফিসার ঘোষণা করলো আসামী সনাক্ত, ভিক্টিম পরকীয়া ইস্যুতে নিহত হয়েছে। তারপর সিআইডি ঘোষণা একই রকম। পিবিআই তথ্য সংগ্রহ করে সেরকম তথ্যই পায়।
কিছু নাম চলে আসে সবার মুখে মুখে– রেনুকা, শিউলী, মিম, যমুনা। সবার সাথে কথা বলে পিবিআই। ভিক্টিম পরকীয়া আসক্ত ছিল এটা বুঝা গেলেও হত্যাকারী কে স্পষ্ট হল না এবং পরকীয়ার কারণেই হত্যা এটা পিবিআই বিশ্বাস করতে চায়নি।
এর মধ্যে মামলাটির তদন্ত কারা করবে এটা নিয়ে নেপথ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হলে কোন প্রকার ক্লু না পেয়েই মামলাটি পিবিআই অধিগ্রহণ করে নেয়। এসআই খালেককে তদন্তভার দেয়া হলেও ইউনিট ইনচার্জসহ সবাই এর সাথে সম্পৃক্ত হয়। পিবিআই হেঃ কোঃ সাপোর্ট দেয়।
পিবিআই পরকীয়া বাইরে কিছু আছে কিনা জানার চেষ্টা করে। দুইটি নম্বর পাওয়া গেল যারা ঐ রাতে নিজেদের মধ্যে অসংখ্যবার কথা বলেছে এবং ভোর চারটা পর্যন্ত সেটা চলে।
এই দুইজনের মধ্যে একজন ভিক্টিমের পাশের দোকানদার আরিফুল যিনি ভিক্টিমের মতোই ইলেকট্রনিকস পন্য ব্যবসায়ী।
অন্যজন নিরঞ্জন তির্কী (উপজাতি) যিনি আরিফুলের খুব কাছের বন্ধু। নিরঞ্জনের বাসা আরিফুলের দোকানের পেছনেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ভিক্টিম নিহত হওয়ার পরে আরিফুলের দোকান দুই তিন দিন বন্ধ ছিল। জানা গেল একই রকম পন্য বিক্রেতা হওয়ার কারণে দুই দোকানদারের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল। প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে মতিন ( ভিক্টিম) এগিয়ে থাকতো।
মতিন একদিকে ইলেকট্রনিক পন্য বিক্রেতা অন্যদিকে মেকানিক। এসব কারণে মতিনের মালামাল বেশী বিক্রি হত। এটা ছিল আরিফের একটা ঈর্ষার বিষয়।
এছাড়াও তিন/চার মাস আগে স্কুল মাঠে একটা ইসলামী জলসায় বক্তার বক্তব্য কে কেন্দ্র করে আরিফ আর মতিনের সাথে ঝগড়া লেগে যায়।
অন্যদিকে নিরঞ্জন তির্কী যখন বাড়িতে থাকে না তখন রাতে কে বা কারা নিরঞ্জনের ঘরের দরজায় টোকা দেয় তার বউকে উত্যক্ত করার জন্য।
আরিফ নিরঞ্জনকে আর আর তার বউ পদ্মাকে বুঝায় এটা মতিনেরই কাজ। এসব কারনে মতিন টার্গেটে পরিনত হয় আরিফ আর নিরঞ্জনের। পিবিআই, সিরাজগঞ্জ আরিফ এবং নিরঞ্জনকে গ্রেফতার করে গত ২৪ আগস্ট ।
তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় — ঘটনার দিন রাত একটার দিকে মতিন দোকান বন্ধ করে মোটরসাইকেলে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলে দোকানের কাছেই (২০০ গজের মধ্যে) তার মোটরসাইকেল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আটকে দেয় নিরঞ্জন, মিঠুন ( নিরঞ্জনের ছেলে), পদ্মা ( নিরঞ্জনের স্ত্রী) , আরিফ।
প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর মতিন এবং আরিফ একে অপরের গলা চেপে ধরে। পদ্মা, মিঠুন আরিফকে বাচাঁতে মতিনের হাত ছাড়িয়ে দেয়। তারপর আরিফ নিরঞ্জনের হেল্প নিয়ে মতিন কে মাটিতে ফেলে ঘাড় মটকে দেয়।
পদ্মা আর মিঠুন মতিনের হাত পা মাটিতে চেপে ধরে যাতে নড়তে না পারে। কিছুক্ষণ পরে আরিফ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ঘটনার সময় অন্যলোক যাতে না আসে সেজন্য রাস্তায় পাহারা দেয় রাহুল আর মন্টু যারা ওদেরই লোক।
নিস্তেজ মতিনকে নিয়ে প্রথমে নিরঞ্জনের বাড়িতে রাখে তারপর মতিনের মোটরসাইকেলটি তিন কিঃমিঃ দূরে ডোবার মধ্যে রেখে আসে মিঠুন ও আরিফ ।
তারপর মতিনকে মৃত ভেবে (নিঃশ্বাস অনুভূত হয়নি) কাছেই স্কুলসংলগ্ন টয়লেটের কাছে ধরাধরি করে নিয়ে যায় আরিফ, নিরঞ্জন, মিঠুন, পদ্মা।
নিরঞ্জন ও মিঠুন টয়লেটের ছাদে উঠে অন্যদিকে আরিফ মতিনের লাশ নীচ থেকে ধরিয়ে দেয়।
মতিনের দেহ টয়লেটের ছাদ থেকে নীচের দিকে (টয়লেটের ভিতরে) ফেলে দেয় নিরঞ্জন ও মিঠুন।
ভিক্টিমের দেহটি টয়লেটের কাছে টিউবওয়েল এর উপর পড়লে ভিক্টিমের ভ্রুর কাছ থেকে কেটে যায় এবং রক্ত বের হতে থাকে। এভাবেই ভিক্টিমের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
ঘটনার সত্যতা ও সসম্পৃক্ততা স্বীকার করে গতকাল (২৬/০৮/২১) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে আরিফ এবং নিরঞ্জন।
তদন্তকারী কর্মকর্তাঃ এস আই আঃ খালেক, তদারকি কর্মকর্তাঃ এসপি রেজাউল করিম, পিবিআই, সিরাজগঞ্জ।