বন্যার আরও অবনতি

জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

বিঘ্নিত রেল যোগাযোগ

মহসীন আহমেদ স্বপন: গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উত্তারঞ্চাল প্লাবিত হওয়ার পর এখন মধ্যাঞ্চালেও প্রভাব বিস্তার করছে। বুধবার (১৭ জুলাই) সকালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ১৪৩, ঘাঘট নদীর পানি ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই দুই নদীর পানির তোড়ে বিঘিœত হয়েছে রেল যোগাযোগ। অতিরিক্ত পানির স্রোতে তলিয়ে গেছে গাইবান্ধা-বালাসীঘাট ও গাইবান্ধা-লক্ষীপুর-রংপুর সড়ক।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীবেষ্টিত কাজীপুর, সদর, বেলকুচি, এনায়েতপুর, চৌহালী, শাহজাদপুর উপজেলার চরাঞ্চলের অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি এসব উপজেলায় ভাঙনও রয়েছে। ভাঙনে ফসলি জমি, বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বন্যার পানিতে ডুবে কাজীপুর উপজেলায় সুমন নামের এক শিশু ও কবির হোসেন নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১ হাজার ৫৬২ পরিবার। গতকাল বুধবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৪ দশমিক শূন্য ৩ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে, যা বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হাসান সিদ্দিক জানান, যমুনা নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ভাঙন। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। উপজেলার বাঐখোলায় বাঁধে ধস নামলে তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পাউবো। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, তিন দিন ধরে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। ফলে জেলার কাজীপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী অন্তত ৩৫টি ইউনিয়নে ৯৩৬ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক লাখ ৬৮ হাজার ১০ জন, এক হাজার ৮৬টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ২০ হাজার ৪০০ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে গাইবান্ধা জেলার কয়েক জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।
গাইবান্ধা জেলা শহরের আলাই নদীর পানি মুন্সিপাড়া, বানিয়ারজান, কুঠিপাড়া সবুজপাড়া, পূর্বপাড়া, ডেভিড কোম্পানীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলা শহরের পুরাতন বাজারে পানি ঢুকে পড়ায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বানের পানিতে রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, পুকুর ও মৎস্য প্রকল্পের মাছ ভেসে গেছে।
অতিরিক্ত পানির স্রোতে তলিয়ে গেছে গাইবান্ধা-বালাসীঘাট ও গাইবান্ধা-লক্ষীপুর-রংপুর সড়ক। জেলায় বন্যায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ঘরবাড়ী ডুবে যাওয়ায় মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন সড়কে। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে বন্যাকবলিতরা। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। শৌচাগার না থাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নেয়া মহিলারা পড়েছেন বিপাকে।
জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের ২২৪টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৬৬ জন মানুষ। কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১২ কিলোমিটার ও বাঁধ চার কিলোমিটার। বন্যার পানিতে কালভার্ট ধসে গেছে ১৫টি, ফসল নিমজ্জিত রয়েছে এক হাজার ৭৫৪ হেক্টর ও ৩২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
গাইবান্ধার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট
ঘরবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৯ হাজার ২৩০টি, আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১১৪টি। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ২০ হাজার ৭২৬ জন। প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করা রয়েছে সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর উপজেলায় ১৩০টি।
এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধের অনেকগুলো এলাকা। মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্যাকবলিত এলাকায় ৪০০ মেট্রিক টন চাল ও ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, যমুনা নদীর পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জের নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের অন্তত সাড়ে ৯০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার ফসলি জমি ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২১ হাজার পরিবার। এদিকে, যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় আরো বেড়ে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ও কাজিপুর পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কে এম রফিকুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৩ দশমিক ৭৭ মিটার রেকর্ড করা হয়। যা বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। (ডেঞ্জার লেভেল ১৩ দশমিক ৩৫)। কাজীপুর পয়েন্টে রেকর্ড করা হয় ১৬ দশমিক ৫ মিটার যা বিপৎসীমার ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আরো দু’একদিন পানি বাড়তে পারে বলে জানান তিনি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানিয়েছেন, যমুনার পানি বাড়ার তীব্রতার কারণে চরাঞ্চল অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। দুপুর পর্যন্ত ৫টি উপজেলার ৯৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের ২১ হাজার ৫৫২ পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যার্তদের বিতরণের জন্য ৪৯৪ টন চাল ও ৮ লাখ টাকা মজুদ রয়েছে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে এগুলো বিতরণ করা হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *