ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট কাস্টমস এক্ট

উপ-সম্পাদকীয়/মতামত

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরী : #ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে পন্য চালান পরিবহনের পদ্ধতি কি? এক্ষেত্রে করনীয় কি? ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট বিষয় কাস্টমস এক্ট, ১৯৬৯ কতো ধারায় এ বিষয় উল্লেখ আছে?


বিজ্ঞাপন

আলোচনাঃ

কাস্টমস ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট বিধিমালা-২০২১ ,এস,আর,ও নং-১৩৬/আইন/২০২১/১২৫/কাস্টমস,তাং-২৫/৫/২০২১ খ্রিঃ এবং
ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট পণ্যের কাস্টমস ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১০ খ্রিঃ এস, আর, ও নং- ১৮২/আইন/২০১০/২৩০০/শুল্ক, তাং ১০/৬/২০১০ ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট পন্যের বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থিত হবে। একই সাথে কাস্টমস এক্ট, ১৯৬৯ এর ১২১ ধারা থেকে ১২৯ ধারা ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট পণ্যের রিলেটেড ধারা।

বিধিমালা অনুযায়ী এখানে আগে জেনে নেই ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট কী?

#ট্রানজিটঃ ট্রানজিট অর্থ বাংলাদেশের কোন কাস্টমস স্টেশনে পণ্য আমদানির পর উক্ত পণ্য একি পরিবহনের মাধ্যমে অন্য কোন কাস্টমস স্টেশন দিয়ে দেশের বাহিরে রপ্তানি হওয়া। পক্ষান্তরে ট্রান্সশিপমেন্ট হলো ;

#ট্রান্সশিপমেন্টঃ অর্থ বাংলাদেশে কোন কাস্টমস স্টেশনে পন্য আমদানির পর উক্ত পণ্য অন্য পরিবহনের মাধ্যমে একই বা অন্য কোন কাস্টমস স্টেশন দিয়ে দেশের বাহিরে রপ্তানি হওয়া, এবং এক কন্টেইনার হতে অন্য কোন কন্টেইনারের মাধ্যমে রপ্তানি হওয়াও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে।

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টঃ
চুক্তি, প্রটোকল বা এস,ও,পি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর অনুমোদিত সড়ক, নৌ, রেল, আকাশ পথে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট পণ্য পরিবহণ করিতে হইবে।

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট মেয়াদঃ
বাংলাদেশের বন্দরে প্রবেশের পর ৭ দিন মানে ৭ দিনের মধ্যে পণ্য দেশের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে সম্পন্ন করতে হবে, কোন যুক্তিসংগত কারণে উক্ত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা না গেলে সময় শেষ হবার আগেই পণ্য যে বন্দরে এসেছে সেখানের কমিশনার বা কমিশনার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নিতে পারবেন।

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট ফি ও চার্জঃ
ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট এর জন্য বোর্ড কর্তৃক এ উদ্দেশ্যে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত হারে প্রশাসনিক ও অন্যান্য ফি এবং চার্জ আদায়যোগ্য হবে।

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট করা যাবে না যে পণ্যঃ
(১) কাস্টম এক্ট,১৯৬৯ এর ধারা ১৫ অনুযায়ী আমদানী নিষিদ্ধ পণ্য;
(২) অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক পদার্থ;
(৩) মদ, মদ জাতীয় পানীয় ও মাদক দ্রব্য;
(৪) বিপদাপন্ন প্রজাতির প্রাণি, উদ্ভিদ ও জীবজন্ত;
(৫) পারমাণবিক এবং তেজস্ক্রিয় সামগ্রী;
(৬) সকল ধরণের বর্জ্য ও দুষিত পদার্থ;
(৭) বিষাক্ত ও হ্যাজার্ডস কেমিক্যাল;
(৮) ব্যাগেজ;
(৯) ডাকযোগে আমদানী পণ্য;
(১০) প্রচলিত আইন ও বিধি দ্বারা আমদানী নিষিদ্ধ কোন পণ্য;

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট পণ্যের ঘোষণাঃ
ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট কার্গো ঘোষণা বর্তমানে যেভাবে আই,জি,এম ঘোষণা যেভাবে সেভাবে একি পদ্ধতিতে দিতে হইবে। অর্থাৎ যানবাহন ছেড়ে আসা দেশের সর্বশেষ বন্দর ত্যাগ করার পূর্বেই ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে কাস্টমস কম্পিউটার সিস্টেমে ঘোষণা দিতে হবে।

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট কার্গো সীলগালা/লকঃ
ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট কার্গো পরিবহণের সময় সকল ক্ষেত্রেই কন্টেইনার, ট্যাংকার, জাহাজের আবব্ধ খোল, সীল/লক করে দেশের অভ্যন্তর দিয়ে পরিবহণ করে নিতে হবে।

#ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট কার্গো পরিবহণে গ্যারান্টিঃ
সংশ্লষ্ট চুক্তি, প্রটোকল, বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরে ভিন্ন কিছু না থাকিলে প্রতি ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট কার্গো পরিবহণের সময় ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করিতে হইবে। প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ০৭ কার্য দিবসের মধ্যে গ্যারান্টি/অংগীকার নামা ফেরত নিতে হইবে। তবে একই অনুমোদিত এজেন্ট কর্তক একাধিক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট কার্গো চালানের ক্ষেত্রে সমন্বিত গ্যারান্টি দাখিলের সুযোগ দেওয়া যাইবে। সমন্বিত গ্যারান্টি হলো একটি গ্যারান্টি দিয়ে একাধিক চালান খালাস নেওয়া ব্যক্তি/এজেন্ট যিনি ইতোপূর্বে ২০ টি চালান গ্যারান্টি দিয়ে নিয়েছে কিন্তু কোন অনিয়ম পাওয়া যায়নি সেই ব্যক্তি এমন প্রিভিলেজ পাবেন।

#ট্রান্সশিপমেন্ট উদাহরণস্বরুপঃ
চট্টগ্রাম বন্দর এবং বাংলাদেশের মহাসড়ক ব্যবহার করে ভারতের ৪ কন্টেইনার পণ্য যাবে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও আসামে। কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর (সাবেক কলকাতা বন্দর) থেকে স্টিলসীটবাহী এসব কন্টেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর চারটি কন্টেইনার খালাস হবে। অতপর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হেফাজতে এ পন্য আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হবে।

জাহাজ থেকে বন্দরে ভারতের কন্টেইনার খালাস কালে বন্দর ও কাস্টমস তাদের নির্ধারিত চার্জ, ফি(যদি থাকে) আদায় করবে। চট্টগ্রাম কাস্টমস এর হেফাজতে বন্দর থেকে সরাসরি কন্টেইনার বাহন আখাউড়া সীমান্তে হয়ে আগরতলায় হয়ে ত্রিপুরার নেওয়া হবে। । চালানটি আগরতলায় ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট বা আইসিপি হয়ে যাবে।

এ চালানে পণ্য পরিবহন বাবদ ভাড়া ও প্রস্তাবিত বিভিন্ন মাশুল পাবে চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। নির্ধারিত বিভিন্ন মাশুল বাবদ বাংলাদেশ প্রতি কন্টেইনার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত মাশুল (ট্রান্সশিপমেন্ট ফি) পাবে, একিভাবে সড়কপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া পাবে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান কারণ পন্য জাহাজ থেকে বাংলাদেশী মালিকানা প্রতিষ্ঠানের ট্রেইলারে করে মানে ট্রান্সশিপ করে আখাউড়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন।

উপরের বর্ননা অনুযায়ী দেখা যায় আলোচ্য যে চারটি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আখাউড়া দিয়ে ত্রিপুরা ও করিমগঞ্জ যাবে তা মুলত ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় যাবে। এক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট পন্য ঘোষণা ও সুরক্ষা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি কাস্টমস কিভাবে করবেন?

(১) #প্রথমত পন্যের ঘোষণা থাকবে কাস্টমস কর্মকর্তা তা দেখবেন ;

(ক) ট্রান্সশিপমেন্ট পন্য আমদানি পর্যায়ে IGM (Import General Manifesto) এ সুস্পষ্টভাবে “For Transhipment(ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য)” উল্লেখ থাকতে হবে । তবে এই ঘোষণা অনলাইনেও দেওয়া যাবে। অতপর ;

(খ) ডিক্লারেন্ট(পন্যের বাহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি/এজেন্ট/ বা মনোনীত ব্যক্তি বা রপ্তানিকারক) পন্য আমদানির পর ট্রান্সশিপমেন্ট পন্য ঘোষিত বিল অব এন্ট্রি দাখিল করবেন।

(২) #বিল অব এন্ট্রি দাখিলের পর কাস্টমস কর্মকর্তা ট্রান্সশিপমেন্টকৃত পন্য চালানের কর/ফি আদায় করবেন।
ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে যে সকল ফি অন্য এন্ট্রি স্টেশনে আদায়যোগ্য তা হলো;

(ক) সড়ক পথে ও রেলপথে প্রতি কন্টেইনার ও টন প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফি আদায়যোগ্য হবে;

(খ) কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হারে স্ক্যানিং ফি পরিশোধযোগ্য হবে;

(গ) শুল্ক কর্তৃপক্ষ ব্যতিত অন্য কোন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা পন্য ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চার্জ বা টোল আরোপিত হইলে তা ডিক্লারেন্টকে পরিশোধ করতে হবে।

(৩) #কাস্টমস কর্মকর্তা দেশের মধ্যে দিয়ে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যে সুরক্ষা ব্যবস্থা নেবেন তা হলো;

(ক) উক্ত পণ্য কন্টেইনারজাত বা কাভার্ড ভ্যান/ট্রাকজাত হইলে কাস্টমস কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষরিত সীল গালা করে সুরক্ষিত করতে হবে।

(খ) উক্ত পণ্য জাহাজে আমদানিকৃত হইলে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস স্টেশন পণ্যের বিস্তারিত তথ্য পরবর্তী কাস্টমস স্টেশনে অগ্রীম প্রেরণ করবেন।

(গ) ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের বাহন পরবর্তী কাস্টমস স্টেশনে পৌঁছানের পর কাস্টমস কর্মকর্তা কন্টেইনার/বাহন/ট্রাকের সীলের অখণ্ডতা পরীক্ষা করে দেখবেন, পূর্ববতী স্টেশন থেকে অগ্রীম প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখবেন।

(ঘ) বর্নিত (গ) অনুযায়ী পরীক্ষায় সীল ভাংগা পাওয়া গেলে বাহনকারী দায়িত্ব বহন করবেন এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুসারে ব্যবস্থা নেবেন।

(৪) #ট্রান্সশিপমেন্ট পন্যের ইন্সিওরেন্সঃ

ট্রান্সশিপমেন্টের প্রতিটি চালানে যথাযথ ইন্সিওরেন্স কাভার নোট থাকতে হবে, তবে ইন্সিওরেন্স কাভার নোট সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক “গ্যারান্টি আন্ডারটেকিং” দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।

(৫) #ট্রান্সশিপমেন্ট পন্য চালান পরীক্ষনঃ

(ক) কন্টেইনার, কাভার্ড ভ্যান/ট্রাকে পন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আগেই বলা হয়েছে যে কাস্টমস স্টেশন দিয়ে পণ্য চালান দেশের মধ্যে প্রবেশ করবে সেখানকার কাস্টমস কর্মকর্তা চালান সীল গালা করে দেবেন, উক্ত সীল যতক্ষণ পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকিবে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যকোন কাস্টমস কর্মকর্তা উক্ত পন্য কায়িক পরীক্ষা করবেন না। তবে সীল ভাংগা পাওয়া গেলে মধ্যবর্তী বা এক্সিট পয়েন্টে কাস্টমস কর্মকর্তা উক্ত চালান কায়িক পরীক্ষা করে ঘোষণার সাথে মিল আছে কিনা দেখবেন, যদি অসামঞ্জস্য পাওয়া যায় তাহলে ডিক্লারেন্টের বিরুদ্ধে আইনানুসারে ব্যবস্থা নিবেন। এমনকি ঘোষণা অপেক্ষা কম পন্য পাওয়া গেলে কম প্রাপ্ত পন্যের শুল্ককর ডিক্লারেন্ট হতে আদায়ের ব্যবস্থা নিবেন। উল্লেখ্য কোন গোপন সংবাদ থাকলে পণ্য চালান পরীক্ষা করে দেখা যাবে।

(খ) যে সকল কাস্টমস স্টেশনে কন্টেইনার স্ক্যানিং করার ব্যবস্থা আছে সে সকল স্টেশন দিয়ে ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য চালান স্ক্যানিং করে নিতে হবে ।

(গ) আমদানিকৃত ট্রান্সশিপমেন্ট চালান স্ক্যানিং করা হোক বা না হোক কমিশনার বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে কোন চালান পরীক্ষা করতে পারবেন।

(৬) #সবশেষে;

এক্সিট পয়েন্ট কাস্টমস স্টেশনের কার্যক্রমঃ ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য চালান এক্সিট পয়েন্ট কাস্টমস স্টেশনে পৌঁছানের পর যথোপযুক্ত কর্মকর্তা উক্ত পন্য চালানের বিপরীতে এন্ট্রি পয়েন্ট হতে প্রদত্ত রিলিজ অর্ডার, ট্রান্সশিপমেন্ট পরিশোধের রশিদ ইত্যাদি পরীক্ষা করে সঠিক পেলে উক্ত পণ্য দেশের বাহিরে যাওয়ার অনুমতি দেবেন।