আস্থার প্রতীকে অনাস্থা

বিশেষ প্রতিবেদন

আস্থার প্রতীক ই-ক্যাবের সদস্য নয়। ভুক্তভোগীরা ই-ক্যাবে কোনও অভিযোগও দেয়নি। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা সাধারণত অভিযোগ করতে চান না। তাদের ধারণা অভিযোগ করলে তারা কোনও টাকা পাবেন না।
জাহাঙ্গীর আলম শোভন, মহাব্যবস্থাপক, ই-ক্যাব


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ই-কমার্স প্লাটফর্ম ‘আস্থার প্রতীক’-এ বিশাল ছাড়ে চিনি, চাল, তেল, গুঁড়ো দুধ কেনার জন্য অর্ডার করে ফেঁসে গেছেন অনেকে। টাকা দিয়ে পণ্য বুঝে পাননি তারা। অন্যদিকে রিসেলাররাও পণ্য সরবরাহ করে টাকা পাননি ‘আস্থার প্রতীক’ থেকে। এই টাকা উদ্যোক্তারা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ তাদের। আত্মসাৎকৃত টাকার পরিমাণ আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মতো বলে জানা গেছে।
শুধু চিনি, চাল, তেল নয়; ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, টিভিতেও বিশাল ছাড়ে বিক্রির অফার ঘোষণা করে আস্থার প্রতীক। জানা গেছে, দেশে ই-কমার্স সংকট চলাকালেই এটি চালু হয় ও গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আস্থার প্রতীক-এর মোহাম্মদপুরের অফিস বন্ধ করে দিয়েছে উদ্যোক্তারা। ওয়েবসাইটও বন্ধ। তবে সচল আছে ফেসবুক পেজ। পেজে শুক্রবার দুপুরেও পোস্ট দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে রিফান্ড প্রক্রিয়া শুরুর কথা। আগামী সোমবার (৬ ডিসেম্বর) থেকে রিফান্ড দেওয়া শুরু হবে বলে বলা হয়।
ফেসবুক পেজে ‘আস্থার প্রতীক’-এর ঠিকানা ভুয়াপুর, টাঙ্গাইল লেখা। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রুশো তালুকদার। তার তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ফোন দিলে বেশিরভাগ সময় বন্ধ পাওয়া গেছে। একবার রিং বাজলেও তিনি ফোন ধরেননি। রুশো তালুকদার অনলাইন প্লাটফর্ম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবসায়িক গ্রুপ ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটিকে (ডিবিসি) ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, রুশো তালুকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ছাত্র। এ বছরের ১৩ জুলাই ‘আস্থার প্রতীক’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কোম্পানি চালু করেন। বিভিন্ন বিভাগে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন আতিকুর রহমান তালুকদার, হাফিজ আল আসাদ, ইশরাত জাহান, হাসান মাহমুদ তানভীর, ডালিয়া ইউসুফ, আলফি শাহরিয়ার, মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম, সনেট তালুকদার, খন্দকার নাহিদ, ইসরাত জুই, আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল এবং সেগুফতা বুশরা মিশমা নামের কয়েকজনকে।
আস্থার প্রতীক-এর পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের সবাইকে পাওয়া যায়নি। লজিস্টিকস বিভাগের পরিচালক আলফি শাহরিয়ার ফোন ধরে জানান, তিনি আর ‘আস্থার প্রতীক’-এর সঙ্গে নেই। কোম্পানির শেয়ার দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে দেওয়া হয়নি। এখন তিনি কিছু জানেন না। এক প্রশ্নের জবাবে আলফি বলেন, ‘আমি জুলাই মাসে জয়েন করি। অক্টোবরে ছেড়ে দেই। আমার হল খুলে যায়। পড়াশোনার চাপ ছিল।’ জানা গেলো, তিনিও উর্দু বিভাগের ছাত্র।
অপারেশন বিভাগের পরিচালক মো. তরিকুল ইসলাম ফোন রিসিভ করেও কথা বলেননি। কাস্টমার কেয়ার বিভাগের পরিচালক ডালিয়া ইউসুফকে ফোন করা হলে তার ফোন অন্য একজন রিসিভ করে করে জানান, ‘আপু (ডালিয়া ইউসুফ) বাইরে আছেন। ফোন হলের রুমে থাকায় তিনি ধরেছেন।’ ফোন করার কারণ জানালে তিনি ডালিয়া ইউসুফকে জানিয়ে দেবেন বলে জানান। যদিও পরে আর ডালিয়া কলব্যাক করেননি। অন্য পরিচালকদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, সেলারদের টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে রুশো তালুকদার ভিডিও বার্তায় একটা প্রস্তাব দিয়েছে। তার প্রস্তাব অনুযায়ী আমাদের টাকা ফেরত পেতে ৮বছর লাগবে। শুনেছি তিনি এই টাকা দিয়ে ক্যাফে চালু করবেন। তার প্রস্তাব না মানলে হুমকিও দিয়েছেন।
জানা গেছে, টাকা পরিশোধের জন্য রুশো তালুকদার দুটো প্রস্তাব দিয়েছে সেলার ও গ্রাহকদের। প্রথমত—রেস্তোরাঁ চালু। যা থেকে আয় করে দেনা পরিশোধ করা হবে। অন্য প্রস্তাবে বলছে, চুক্তি করার ১৫ দিনের মধ্যে ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হবে পাওনাদারকে এবং প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা করে পরিশোধ করা হবে। ১০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিশোধের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হচ্ছে। প্রস্তাবে রাজি হলে চুক্তি করে সবাইকে চেক দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
জামিল বখতিয়ার নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আস্থার প্রতীক’ সেলার হিসেবে টার্গেট করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশই ঢাবির শিক্ষার্থী হওয়ায় বাকিরা সহজেই তাদের বিশ্বাস করবে, এই সুযোগ অসৎভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিল তারা। প্রথম অফারের সার্ভিস নড়বড়েভাবে সম্পন্ন করে পরে ভালো সার্ভিস দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকার সেল করিয়ে সেলারদের টাকা আটকে দেয়।
জামিল আরও জানানা, সেলারদের প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীদের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগী সেলাররাও ধার দেনা করে টাকা বিনিয়োগ করেছে। তাদের টাকা তো দিচ্ছেই না, বরং মামলার ভয় দেখাচ্ছে প্রতারক চক্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম শোভন জানালেন, আস্থার প্রতীক ই-ক্যাবের সদস্য নয়। ভুক্তভোগীরা ই-ক্যাবে কোনও অভিযোগও দেয়নি। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা সাধারণত অভিযোগ করতে চান না। তাদের ধারণা অভিযোগ করলে তারা কোনও টাকা পাবেন না।


বিজ্ঞাপন