যেহেতু সংক্রমণ আবারও বাড়ছে, এ মুহূর্তে কোনো সভা সমাবেশকে অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি সেকি ধর্মীয়-সামাজিক অথবা রাজনৈতিক যেটি হোক যেই হোক না কেন। কারণ আমরা দেখছি, সম্প্রতি যে সমস্ত সভা-সমাবেশগুলো হচ্ছে- সেগুলোতে কেউই মাস্ক পরছে না, সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির তো কোনো বালাই নেই। আর যদি অনুমতি দিতেই হয়, তাহলে খোলা জায়গায় দেওয়া উচিত।
ডা. মুশতাক হোসেন
উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্বকে কাবু করে রাখা করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশে কিছুটা কমেছে। তবে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের একের পর এক ঢেউ জানান দিচ্ছে, সহসাই বিদায় নিচ্ছে না। বরং থেমে গিয়ে নতুন রূপ নিয়ে ফিরে আসছে আরও শক্তিশালী গতিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে এসেছে কিন্তু আর বিদায় নেয়নি, এমন অনেক মহামারিই আমরা দেখছি। করোনাভাইরাসও সেরকমটিই হতে যাচ্ছে। করোনা থেকে গেলেও সেটি মহামারি আকারে থাকবে না। পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না। এমনকি হাসপাতালও ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীতে উপচে পড়বে না। তাদের দাবি, সাধারণ সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই ছড়াবে এ ভাইরাস।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণ হার খুব কম। এটি আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয়। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। যে কোনো মুহূর্তেই আবারও সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে সেটি অন্যান্য সাধারণ রোগের মতো গণ্য হবে। তবে ন্যূনতম ১৪ দিন এই হার বজায় থাকতে হবে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে তা পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে টানা ৪৫ দিন ধরে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে। ৩ অক্টোবর থেকে শনাক্তের হার তিন শতাংশের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে আর দুই শতাংশের উপরে উঠেনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এখন প্রতিনিয়তই করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসছে। সারা পৃথিবীতে আগে যেমন প্যানডেমিক বা অতিমারি ছিল, এখন সেটা হয়ে যাচ্ছে অ্যানডেমিক। এরমানে রোগটি এই থাকবে, আবার থাকবে না। এই বাড়বে, আবার কমে যাবে ঠিক যেন ইনফ্লুয়েঞ্জার মত।
তিনি বলেন, উত্তর-পশ্চিমা দেশগুলোতে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য প্রতি বছরই একটি করে ভ্যাকসিন নেওয়া হয়ে থাকে। কারণ দেখা যায় যে, সারা বছরই ইনফ্লুয়েঞ্জা পরিস্থিতি ঠিক আছে, কিন্তু শীতকালে আবার একটু বেড়ে গেছে, তাই শীত আসার সময় যেন এই সংক্রমণ না বাড়ে, সে লক্ষ্যে প্রত্যেকে একটি করে ভ্যাকসিন নিয়ে নেয়। করোনাভাইরাসও এ অবস্থায় চলে এসেছে।
কয়েক বছরের মধ্যে সর্দি-কাশির মতোই ‘সাধারণ রোগে’ পরিণত হবে করোনা। যাদের মধ্যে অনাক্রম্যতা (ডিপ্লোম্যাটিক ইমুনিটি) তৈরি হয়নি অর্থাৎ ছোট শিশুরা, তারাই আক্রান্ত হবে এ রোগে— সম্প্রতি পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। গবেষকরা জানান, গবেষণার ফলাফলগুলো বলছে, সংক্রমণের ঝুঁকি সম্ভবত ছোট বাচ্চাদের রয়েছে। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ টিকা বা ভাইরাসের সংস্পর্শের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।
প্রধান গবেষক বিজর্নস্ট্যাড বলেন, যে সমস্ত অতিরিক্ত করোনা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দেখা দিয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে অ্যান্ডেমিক হয়ে গেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘উদাহরণস্বরূপ, চলমান জিনোমিক কাজ থেকে বোঝা যায় যে ১৮৮৯-৯০ মহামারি, যা এশিয়াটিক বা রাশিয়ান ফ্লু নামে পরিচিত- এক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ৭০ বছরের বেশি বয়স্করা আক্রান্ত হয়েছিল হকব-ওসি৪৩ ভাইরাসের কারণে। যা এখন একটি স্থানীয়, মৃদু, পুনরাবৃত্তি-সংক্রামক ঠান্ডা ভাইরাস যা বেশির ভাগ ৭-১২ মাস বয়য়ের শিশুদের মধ্যে ছড়ায়।
এদিকে, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের মহামারি রোগ বিষয়ক প্রফেসর ড. আর্নল্ড মন্টো বলেছেন, কোনটা মহামারিতুল্য (এপিডেমিক) আর কোনটা মহামারি তা নির্ধারণের কোনো মাপকাঠি নেই। বিষয়টি নির্ধারণ করা হয় চোখের দেখার ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলেন, মহামারি নির্ধারণের কোনো মৌলিক আইন বা নিয়ম নেই। কোনো একটি রোগের প্রাদুর্ভাব আপনি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ওপর ভিত্তি করে একে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এক্ষেত্রে পার্থক্য হলো আগের তুলনায় আমাদের টিকাগুলো অধিক কার্যকর। ভাল খবর হলো টিকার শক্তি। খারাপ খবর হলো ভাইরাসটির রূপান্তর ও বিবর্তিত হওয়ার ক্ষমতা। কেউই পূর্বাভাস দিতে পারেন না যে, করোনা ভাইরাসের ভবিষ্যত কি রকম হতে পারে। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রূপ পরিবর্তন করেছে।
শীত মৌসুমের সঙ্গে করোনার কোনো সম্পর্ক আছে কি না- জানতে চাইলে ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, করোনাভাইরাসের সঙ্গে আবহাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা দেখেছি গরমকালেও সংক্রমণ অনেক বেড়েছে, শীতেও বেড়েছে। সুতরাং বলা যায় যে শীতকালের সঙ্গে করোনা সংক্রমণ বাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে করোনা সংক্রমণ বাড়ান অন্যতম একটি রিচ ফ্যাক্টর (বড় কারণ) হলো আবদ্ধ পরিবেশ। এটি সম্ভবত শীতকালেই বেশি তৈরি হয়। কারণ, শীতকালে মানুষ খুব বেশি একটা ঘরের বাইরে বের হন না। আবার বেশি গরম পড়লেও মানুষ ঘর থেকে বের হতে চায় না এবং সারাক্ষণ এসির মধ্যে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর তখনও বদ্ধ ঘরের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ঘোরাফেরা করে এবং ইনফেকশনটা বেড়ে যায়। সবমিলিয়ে বলা যায় যে, আবন্ধ ঘরে ভাইরাসটি দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে এবং ঝুঁকিটা এখানেই বেশি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের আসলে টিকা প্রয়োগের হার খুবই কম। আমরা যদি ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারতাম, তখন হয়তো একটু দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারতাম যে, আমাদের সংক্রমণের এতটা ঝুঁকি নেই। কিন্তু আমরা তো এ মুহূর্তে ২০ শতাংশের কিছু ওপরে মানুষকে প্রথম ডোজের টিকার আওতায় আনতে পেরেছি। দুই ডোজ হিসেব করলে সেটি আরও কম হবে। সুতরাং এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন হলো স্বাস্থ্যবিধিসহ সামাজিক রীতিগুলো পালন করা। আর সেগুলো হলো, হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ কমে গিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। এটিই করোনাভাইরাসের চরিত্র।
তিনি বলেন, করোনার নতুন নতুন ঢেউ যেগুলো আসছে, সেগুলো দেখছি যে পূর্ববর্তীগুলোর চেয়ে অধিকতর শক্তি নিয়ে আঘাত হানছে। সবমিলিয়ে আমরা যেহেতু বুঝতে পারছি করোনার আরেকটি ঢেউ আসবেই, এখন আমাদের লক্ষ্য হলো যেন মৃত্যুরসংখ্যাটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারি।
করোনা প্রতিরোধে করণীয় প্রসঙ্গে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের করণীয় সেই আগের মতই। আমাদের প্রত্যেককে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। প্রত্যেক শনাক্ত রোগীকে আমরা আলাদা করে রেখে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসব। করোনা উপসর্গ থাকে থাকলে দ্রুততম সময়ে করোনা পরীক্ষা করব এবং করোনা আক্রান্ত হলে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করবো।
‘চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেসব জায়গাগুলোতে অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠী বসবাস করে, সেগুলোর আশেপাশের হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। সবশেষে আরেকটি বিষয় হলো- আমরা যে টিকা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, সেটিকে আরও গতিশীল করতে হবে। এক্ষেত্রে যারা বয়স্ক মানুষ, দ্রুততম সময়ে তাদের অধিকাংশকেই টিকার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে,’ যোগ করেন এই সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যেহেতু সংক্রমণ আবারও বাড়ছে, এ মুহূর্তে কোনো সভা সমাবেশকে অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি সেকি ধর্মীয়-সামাজিক অথবা রাজনৈতিক যেটি হোক যেই হোক না কেন। কারণ আমরা দেখছি, সম্প্রতি যে সমস্ত সভা-সমাবেশগুলো হচ্ছে- সেগুলোতে কেউই মাস্ক পরছে না, সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির তো কোনো বালাই নেই। আর যদি অনুমতি দিতেই হয়, তাহলে খোলা জায়গায় দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্টসহ বদ্ধ কোন জায়গায় যদি সমাবেশ করা হয়, তাহলে সেখানকার কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি সংস্থাকে নজর রাখতে হবে যে ফ্লোর স্পেস অনুযায়ী জনসংখ্যা কম আছে কি না। ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে, কতটুকু জায়গার মধ্যে কী পরিমাণ মানুষ থাকতে পারবে। আর এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই অবশ্যই সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।
করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসায় আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের হার অনেক বেশি। অন্যদিকে আফ্রিকায় সংক্রমণ হার অত্যন্ত কম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ভারতে সংক্রমণ হার নি¤œমুখী। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণ হার খুব কম। এটি আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয়। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও টিকা গ্রহণের পাশাপাশি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমেই আমরা অতিমারিকে নির্মূল করতে সক্ষম হবো।
এদিকে, দেশে করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ধরন ওমিক্রনসহ সংক্রমণ রোধে ১৫দফা পদক্ষেপ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এতে সব ধরনের (সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়/অন্যান্য) জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা, বাড়ির বাইরে গেলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা, রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম করতে বলা হয়েছে।
এছাড়াও সব জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল/থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক লোক অংশগ্রহণ, মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।