আজকের দেশ ডেস্ক : কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং সেখানকার রাজনৈতিক দলের নেতাদের গৃহবন্দি করে রেখে রাজ্যটিতে কয়েক দশক ধরে আরোপিত বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকেই সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এ রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনা সদস্যরা। বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ এবং অফিস-আদালত। এছাড়া ল্যান্ডলাইন, মোবাইল এবং ইন্টারনেট যোগাযোগও বন্ধ থাকায় একরকম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
কেউ জানে না সেখানে কি ঘটতে চলেছে। রাজ্যের লোকজন বেশ উদ্বিগ্ন। অন্য এলাকায় থাকা ওই রাজ্যের লোকজন স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সরিয়ে নেয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিলো। কিন্তু এমন ঘোষণায় সেখানকার মানুষ কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। রোববার রাতেই গৃহবন্দি করা হয়েছিলো সেখানকার প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের। সোমবার গ্রেফতার করা হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতিকে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য মতে, রাজ্যের অন্যান্য অংশে কী হচ্ছে তা কেউ জানে না, কেউ কারো সাথে কথাও বলতে পারছে না। মানুষ ভীষণ চিন্তিত, তারাও জানে না আসলে এখন কী হচ্ছে এবং কী হতে যাচ্ছে।
ভারতের অন্যান্য স্থানে থাকা কাশ্মীরিরা তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না এবং সে বিষয়ে তারা তাদের শঙ্কার বিষয়ে জানিয়েছেন।
এদিকে অনেক কাশ্মীরি মনে করেন, সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিত সেটিই ছিল রাজ্যটির ভারতের সঙ্গে জুড়ে থাকার পেছনে প্রধান যুক্তি। আর ঐ অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে দিল্লির সাথে কাশ্মীর অঞ্চলের সম্পর্কের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপরিবর্তনীয়।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ ধরণের স্বায়ত্বশাসন ভোগ করার সুযোগ দিত যার ফলে তারা নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন প্রণয়নের অধিকার রাখতো – যদিও পররাষ্ট্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এই ধারার আওতায় জম্মু ও কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখতো।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষকে জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা থেকেও বিরত রাখতে পারতো ওই ধারার কারণে।
ভারতের সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিলোপের ঘোষণা দেয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই কাশ্মীর উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সংসদে ঘোষণা দেয়ার কয়েকদিন আগে ঐ অঞ্চলে অতিরিক্ত দশ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। পর্যটকদের ঐ এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হয়, হিন্দু তীর্থযাত্রীদেরও নির্দেশ দেয়া হয় ঘরে ফিরে যেতে। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজ্যটিতে কী হতে চলেছে এ নিয়ে কেউই কোনো আঁচ করতে পারেননি। এমনকি মোদির মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরাও নাকি অমিত শাহের এই ঘোষণা নিয়ে অন্ধকারে ছিলেন।
স্থানীয়রা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কয়েক মাসের খাবার মজুদ করে রাখেন। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে ধারণা করে পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য স্যাটেলাইট ফোন বরাদ্দ করা হয়।
রোববার রাতে দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দী করার সময়ই সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। সেসময় থেকে ঐ অঞ্চল কার্যত পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেখান থেকে কোনো কিছুরই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র ঘোষণার পর অতিরিক্ত সেনাও মোতায়েন করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কখন ঠিক হবে, সেবিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি।
জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা কি?
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ ছিল না। মহারাজা হরি সিং-এর অধীনে এখানে প্রচলিত ছিল স্বাধীন রাজতন্ত্র। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২২শে অক্টোবর কিছু পার্বত্য দস্সুরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে, রাজা হরি সিং ভারতের কাছে সেনা সাহায্য চান ভারতভুক্তির (ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন) শর্তে। তাতে জম্মু-কাশ্মীরকে ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়। সে সময়ে বিনা পারমিটে কাশ্মীরে কেউ প্রবেশ করতে পারতো না। এই ৩৭০ ধারার মধ্যেই নিহিত আছে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাস।
এই ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর একটি ব্যতিক্রমী রাজ্য – কারণ প্রতিরক্ষা-পররাষ্ট্র বা যোগাযোগের মতো কয়েকটি বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সেখানে ভারতের কোনও আইন প্রয়োগ করতে গেলে রাজ্য সরকারের সম্মতিও জরুরি। নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিকানা বা মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও এই রাজ্যের বাসিন্দারা বাকি দেশের তুলনায় বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করেন। এটি জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতাও দেয়। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও রয়েছে এ রাজ্যের বাসিন্দাদের।
এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধুমাত্র সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। এমনকি সেখানকার নারীরা কোনো অ-কাশ্মিরী পুরুষকে বিয়ে করলে তারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। এতটাই কঠোর প্রয়োগ ছিল এ ধারাটির।
এখন এই ধারা রদ করার পর সেইসব বাধা পুরোপুরি উঠে যাবে। এরপর ভারতের অন্যান্য স্থানের হিন্দুরা পঙ্গপালের মত ছুটে আসবে উপত্যকার দিকে। অর্থের জোরে তারা দখল করবে নিঃস্ব দরিদ্র কাশ্মিরীদের পৈত্রিক ভূমির অধিকার। বলাবাহুল্য, ভারতীয় সেনাদের নির্যাতন ও নানা বৈষম্যের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই অবদমিত উপত্যকার জনতা।
অমুসলিমরা সেখানে এসে সেখানে এসে কেবল জমি কিনেই ক্ষান্ত হবেন এমন নয়, তারা সেখানে সরকারি চাকুরি ও বৃত্তিসহ নানা সুবিধা নেবে। অর্থাৎ দিনে দিনে গ্রাস করে নেবে গোটা উপত্যকা, যা নিয়ে এতদিন ধরে গর্ব করতো সেখানকার বাসিন্দারা।
আসেল এটি তো গোটা ভারতকে মুসলিম শূন্য করার চক্রান্তের একটি অংশ মাত্র, যা তারা দীর্ঘদিন ধরেই বাস্তাবায়িত করার সুযোগ খুঁজছিলো। এবারের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে পার্লামেন্ট অকল্পনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার কারণে মোদিরা নিজেদের এই চক্রান্তটি বাস্তবায়িত করার সুযোগ পেলো।
কেননা ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীর সংক্রান্ত ৩৭০ নং ধারা রদ করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিলো, যা রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞপ্তি জারি করে তা সংশোধন করতে পারেন। ইতিমধ্যে বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ স্বাক্ষরও করেছেন।
কেবল কাশ্মীরে নয়, ভারতের বিভিন্ন অংশেই চলছে হিন্দুত্ববাদী শক্তির জবর দখল। কখনও তা বহিরাগত তাড়ানোর নামে (আসামের এনআরসি), কখনও বা অন্য কোনো মোড়কে।