মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় অসন্তোষ

বিশেষ প্রতিবেদন

*মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব
*কেউ ইচ্ছে করলেই ক্রসফায়ার করতে পারে না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
*র‌্যাবের মানবিকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোনও বাহিনীর নেই

 


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকারের সঙ্গে কোনও আলাপ ছাড়াই পুলিশ প্রধান (আইজিপি) ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ ছয় কর্মকর্তার ওপর এককভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। শনিবার সকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে তলব করে যুক্তরাষ্ট্রের এধরনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের হতাশার কথা ব্যক্ত করেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র সচিব জানান, যে কারণে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেটি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের নিয়মিত সংলাপে আলোচনা হয়ে থাকে কিন্তু এরপরেও কোনও ধরনের আগাম বার্তা না দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্র সচিব দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যে সংস্থাকে মার্কিন সরকার ছোট করেছে ওই সংস্থাই বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ, মাদক চোরাচালান এবং অন্যান্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ রোধে কাজ করছে এবং ওইসব বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
পররাষ্ট্র সচিব আরও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যেসব অভিযোগ র‌্যাবের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সেগুলো শুধু মার্কিন প্রশাসনকেই নয় বরং জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার মেকানিজমে একাধিকবার ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
মাসুদ বিন মোমেন রাষ্ট্রদূতকে জানান, মার্কিন সিদ্ধান্তটি মনে হয় ভুল ও পরীক্ষা করা হয়নি এমন সূত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।
কোনও সংস্থার নাম ধরে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে দুদেশের সম্পর্কে উন্নতি হবে না এবং তিনি সংলাপ, আলোচনা ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন।
রাষ্ট্রদূত মিলার পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য আমলে নিয়েছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশের বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠানো হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন দুইদেশের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক আলোচনা ও উচ্চ পর্যায়ের সফরের মাধ্যমে আরও গভীর হবে।
সামনের দিনগুলোতে দুইদেশের জন্য প্রযোজ্য এমন বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র আরও আলোচনা করবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত মিলার।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব : র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ড. বেনজীর আহমেদ (বর্তমানে পুলিশের মহাপরিদর্শক) ও বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ ছয়জন কর্মকর্তার ওপর কেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো তা জানতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শনিবার সকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন তাকে ডেকে পাঠান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে এবং তিনি নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।’
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কোনও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার প্রধানকে যুক্ত করা যুক্তরাষ্ট্রের একটা নতুন ঢঙ। র‌্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দুঃখজনক।’
ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যেকোনও অভিযোগ তথ্যভিত্তিক হওয়া উচিত। ১০ বছরে ৬০০ লোককে মারা হয়েছে ঢালাওভাবে বলা ঠিক না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরিপক্ক গণতন্ত্রের কাছ থেকে এমন ঢালাও অভিযোগ কাম্য নয়। কারণ তাদের দেশে প্রতি বছর ৬ লাখ লোক নিখোঁজ হয়।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র‌্যাব-এর সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ সংস্থাটির ছয় কর্মকর্তা ও র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকায় এই তথ্য দেখা গেছে। মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বলছে, ‘বাংলাদেশ সরকারের মাদকবিরোধী যুদ্ধে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে র‌্যাব।’
কেউ ইচ্ছে করলেই ক্রসফায়ার করতে পারে না: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ ইচ্ছে করলেই ক্রসফায়ার কিংবা গুলি করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন।
শনিবার রাজধানীর ওয়াসা ভবনে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বন্দুকযুদ্ধের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সবগুলোরই একটি জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি হয়। যে ঘটনা ঘটলো তার পেছনে যথাযথ কারণ ছিল কিনা, নাকি গাফিলতি ছিল। কোথাও গাফিলতি পেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমেরিকান সরকার একটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এই প্রতিবেদনটি এখনও আমার টেবিলে আসেনি। এটা আমাকে দেখতে হবে, এটা কেন তারা কীভাবে, কী কারণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। না দেখে পুরো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। এ সমস্ত ঘটনার পেছনে কোনও কারণ ছিল বলেই আমাদের কাছে প্রতীয়মান। এ সমস্ত ঘটনা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন কুমিল্লায় প্রকাশ্যে ৮ থেকে ৯ জন সন্ত্রাসী যেভাবে বন্ধুক উঁচু করে গুলি করছিল, এদের কাছে গিয়ে যদি নিরাপত্তা বাহিনী বলেও আসে; এরা আবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কুমিল্লায় ঘটেছে, আপনারা দেখতে পেয়েছেন। সন্ত্রাসীরা যখন আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে, তখন আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর জীবন রক্ষার্থে হয়তো অনেক সময় গুলি করে থাকে। তখন সেটা তার জন্য বৈধ ছিল। আর তখন সেটা যুক্তিসঙ্গত ছিল কিনা তার তদন্ত হচ্ছে।
র‌্যাবের মানবিকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোনও বাহিনীর নেই : মাত্র ৯ হাজার ফোর্সের র‌্যাব জঙ্গি ও দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে যে মানবিকতা দেখিয়েছে পৃথিবীতে অন্য কোনও বাহিনীর এমন নজির নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাবের অফিসারসহ ২৮ জন প্রাণ দিয়েছেন, একহাজারের মত সদস্য পঙ্গু হয়েছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভবিষ্যতেও র‌্যাব জীবন দিয়ে কাজ করবে। শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে বাহিনীর মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এই তথ্য জানান।
র‌্যাবের ছয় শীর্ষ বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিসিয়ালি আমরা কোনও চিঠি পাইনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা বলতে চাই, র‌্যাব কখনও মানবাধিকার লুণ্ঠন করেনি, রক্ষা করেছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমন হয়েছে। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। সুন্দরবনের ৩৬ টি দস্যু বাহিনীর ৩২৬ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের সুস্থ জীবন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আল মঈন বলেন, জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করেছে, তারাও সুস্থ জীবনে ফিরেছে। জঙ্গি ও দস্যুসসহ ৪২১ জনকে র‌্যাব সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। আমার জানা নেই বিশ্বে আর কোনও বাহিনী আছে কিনা যারা এমন মানবিকতা দেখিয়েছে।
ক্রসফায়ারের বিষয়ে র‌্যাবের এই পরিচালক বলেন, বিভিন্ন সময় আমাদের বিরুদ্ধে গুলিবিনিময়ের অভিযোগ করা হয়। আপনারা জানেন রাষ্ট্রের আইনে প্রতিটি নাগরিকের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন অভিযানে যায়, তখন সন্ত্রাসীদের বাধার মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলিবিনিময়ের অধিকার রাষ্ট্রের আইন আমাদের দিয়েছে। মাদক, জঙ্গি দমনের অভিযানে আমরা যখন প্রতিরোধের মুখে পরেছি তখনই গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। র‌্যাব আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে।
ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনার স্বাধীনভাবে তদন্ত হয় বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিটি গুলি বিনিময়ের ঘটনা নির্বাহী তদন্ত হয়। তারা দেখে গুলি বিনিময় যথাযথ ছিল কিনা। যারা আইন ভঙ্গ করে, নিয়ম ভঙ্গ করে তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব সবসময় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।