ঠিকানা না থাকলে চাকরি হবে না, এটা হতে পারে না: হাইকোর্ট

আইন ও আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক : মেধা তালিকায় শীর্ষে থেকেও পুলিশ কনস্টেবল পদে ভূমিহীন হওয়ায় খুলনার মীম আক্তারকে কেন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
এসময় আদালত বলেন, ‘ঠিকানা না থাকলে চাকরি হবে না, এটা হতে পারে না। কোথায় তারা উৎসাহ দেবে সেটা না করে নিরুৎসাহিত করছে। এমনটা হতে পারে না।’
মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করে আদেশ দেন। পরে আদালত মীমের চাকরি না হওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আগামীকালের মধ্যে জানাতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেন।
জানা যায়, ৩২ বছর আগে বাগেরহাট থেকে খুলনায় আসেন রবিউল ইসলাম। এরপর স্ত্রী-কন্যা নিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন সোনাডাঙ্গা এলাকায়। তাদের মেয়ে মীমের বয়স এখন ১৮ বছর।
খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার ৩ নম্বর আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের ডা. বাবর আলীর ভাড়াটিয়া বাড়ির বাসিন্দা সে। তার বাবা মো. রবিউল ইসলাম খুলনার বয়রা ক্রস রোডে ভাড়ায় ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে লেপ-তোশকের ব্যবসা করেন। বেডিং হাউস নামে একটি দোকানও রয়েছে তার।
মীম আক্তার জানান, পুলিশে কনস্টেবল পদে সাধারণ নারী কোটায় আবেদন করেন তিনি। গত ২৫ অক্টোবর থেকে তিন দিন খুলনা শিরোমনি পুলিশ লাইন্সে শারীরিক যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২৮ ডিসেম্বর খুলনা সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হওয়া লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন মীম। মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন। ফল প্রকাশের পর জানতে পারেন, তিনি মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন। এরপর খুলনা জেলা পুলিশ লাইন্সে সাধারণ মেডিকেল পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন।
তিনি বলেন, তারপর ১২ নভেম্বর রাতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে। সেখানে ১৩ নভেম্বর সকালে মেডিকেল পরীক্ষা হয়। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি। সেখান থেকে বলা হয়েছিল, পরবর্তীতে ফলাফল জানানো হবে। এরপর পুলিশ ভেরিফিকেশন শুরু হয়। সোনাডাঙ্গা থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও সিটিএসবি থেকে বাড়িতে তদন্তে আসে। তাদের কাছে ভূমিহীন সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি। তারা বলেছিলেন, ৫ ডিসেম্বর আমাকে জানাবেন। ফোন দিয়ে ৭ ডিসেম্বর জেলা পুলিশ লাইন্সে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য ডাকা হয়। সেখানে পাঁচ আঙুলের ছাপ দিয়ে এসেছিলাম। সেখান থেকে বলেছে, পরে জানিয়ে দেয়া হবে। এরপর থেকে আর কিছুই জানায়নি।
মীম বলেন, ফোন দিয়ে যারা ফিঙ্গার দিয়ে এসেছিল তাদের চাকরির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু আমাকে কিছু না জানানোর কারণে আমি শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) জেলা পুলিশ লাইন্সে গিয়েছিলাম। তারা কিছুই জানেন না জানিয়ে এসপি স্যারের সঙ্গে কথা করতে বলেন। এরপর শনিবার (১১ ডিসেম্বর) খুলনা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গিয়েছি। পুলিশ সুপার স্যারকে পাইনি। ২ থেকে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভির আহম্মেদ স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। স্যার বলেছেন, তোমার সব ঠিক আছে। তবে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তোমার চাকরিটা আমরা দিতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসেছি। ভূমিহীন বলে আমার চাকরি হবে না। আমার জন্ম খুলনায়। জন্মসনদও খুলনা সিটি করপোরেশনের।
মীমের বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে এ রোডের আশপাশে বিভিন্নস্থানে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছি। গত ৩২ বছর ধরে পরিবার নিয়ে রয়েছি এখানে। মেয়ের জন্ম খুলনাতে। এখানে আমার নিজস্ব কোনো জমি নেই। এছাড়া গ্রামের বাড়িতেও আমার নামে কোনো জমি নেই। পৈতৃক বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারি থানার বড়বাড়িয়া গ্রামে। বাবা আব্দুল লতিফ শেখ এখনো জীবিত আছেন। তার নামেই সব জায়গা-জমি রয়েছে। আমার নামে জমি নেই। তাই ভূমিহীন বলে আমার মেয়ের চাকরিটা হচ্ছে না।
খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভীর আহম্মেদ বলেন, মেয়েটা সব দিক দিয়েই পারফেক্ট। মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছে। তবুও পুলিশের রুলসের কারণে আমরা তাকে নিতে পারছি না। আইনের বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান বলেন, মীম স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছে খুলনার। কিন্তু সেখানে তার কোনও জায়গা-জমি নেই। তার আসল ঠিকানা বাগেরহাটে। সেক্ষেত্রে সে তথ্য গোপন করেছে। আবেদনে মীম বাগেরহাটের তথ্য উল্লেখ্য করেনি। আর খুলনায় তার পরিবার ৩২ বছর বসবাস করছে সেটাও লেখেনি। এ ছাড়া সে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আনফিট ছিল। শেষ কথা হচ্ছে একজন ভালো প্রার্থীর জন্য আমরাও বেশ চেষ্টা করি।
এর আগে বরিশালের হিজলা উপজেলার আসপিয়া ইসলামের জমি না থাকায় জটিলতা তৈরি হয় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেতে। মেধা ও শারীরিক যোগ্যতার সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ছিলেন শুধু নিয়োগের অপেক্ষায়। তবে শেষ সময়ে বাধে বিপত্তি। আসপিয়া ও তার পরিবারের কেউ ভূমির মালিক না হওয়ায় ‘পুলিশে তার চাকরি হবে না’ বলে জানানো হয়। পরে প্রশাসনের তৎপরতায় আলোর মুখ দেখার পথে আসপিয়ার পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন।


বিজ্ঞাপন