করোনায় কমেছে সংক্রমণ-মৃত্যু
কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার উদাহরণ বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্বের অনেক দেশ যখন করোনার ভয়াল থাবায় জর্জরিত, সেখানে অনেকটাই সফল বাংলাদেশ। পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে এদেশেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল মৃত্যু-সংক্রমণ। তবে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল দেশ। এর নেপথ্যে আছে ধারাবাহিক টিকাদান কর্মসূচি। ফলে ভাইরাসটির তৃতীয় ঢেউ সামলে মৃত্যুর সংখ্যা এখন এক অঙ্কে পৌঁছেছে। যদিও নতুন করে আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন চোখ রাঙাচ্ছে। সেদিকেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্ক দৃষ্টি আছে।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮মার্চ। এর ১০দিন পর ১৮মার্চ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে ৭০বছর বয়সী একজন পুরুষ মারা যান। প্রথম রোগী মারা যাওয়ার ২ মাস ২২ দিন পর, ওই বছরের ১০ জুন দেশে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছায় ১ হাজারে। এই সময়ে গড় মৃত্যু ছিল দিনে ১২ জন।
এরপর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার থেকে ৫ হাজারে পৌঁছাতে সময় লাগে ৩ মাস ১২ দিন। ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭ জনে। এই সময়ে গড়ে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়।
৫ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পর সেই সংখ্যা ১০ হাজারে যেতে সময় লাগে ৬ মাস ২২ দিন। এ সময় করোনায় শনাক্ত এবং মৃতের হার ছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮১ জনে। এই সময়ে গড় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৫ জন।
এরপর রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় লকডাউন দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় আন্তঃজেলা গণপরিবহন। পাশাপাশি সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ বন্ধ করতে ট্রেন এবং সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযানও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সরকারিভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সাধারণ মানুষকে ঠেকানো যায়নি। লাগাম টানা যায়নি রাজধানী ছেড়ে যাওয়া, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত। বিকল্প উপায়ে নানান বাহানায় লোকজন রাজধানী ছেড়েছে, আবার ফিরেছে।
অপরদিকে, সীমান্ত খোলা থাকায় বৈধ-অবৈধ উপায়ে মানুষজন ভারতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে সারা দেশে। ঢাকায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কমে গেলেও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে রাজধানীর বাইরে ক্রমে সংক্রমণ ও মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে।
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল যেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৮১ জন, সেখানে মাত্র ২ মাস ১৯ দিনে (৭৯ দিন) ১০ হাজার থেকে বেড়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৬৫ জন। এই সময়ে গড়ে মৃত্যু হয় ৬৩ জনের।
৩ জুলাই করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৬৫ জন। সেদিন থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার বেড়ে এই সংখ্যা হয় ২০ হাজার ২৫৫ জন। এই সময়ে গড়ে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়।
এর ২৩ দিন পর (২২ আগস্ট) মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ২৮২ জনে। এবার মাত্র ২৩ দিনে মারা যান ৫ হাজার ২৭ জন মানুষ। গড়ে এসময় মারা গেছেন ২১৯ জন করে। এটাই করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে গড় মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড।
২৩ আগস্টের পর থেকে আবারও কমতে শুরু করে করোনায় মৃতের সংখ্যা। সেদিন থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৩০ দিনে মারা গেছেন ২ হাজার ৭৫৬ জন। এ সময়ে গড়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
করোনা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত (৮ মার্চ ২০২০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ২০২১) ১ বছর ৯ মাস ৭ দিনে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ ৮০ হাজার ৩০২ জন। মারা গেছেন ২৮ হাজার ৩৮ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৩ জন।
তবে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে সফলতা এসেছে ধীরে ধীরে। করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার (৮ মার্চ, ২০২০) ১১ মাস পর চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে ফাইজার-বায়োএনটেক, সিনোফার্ম এবং মডার্নার দেওয়া হচ্ছে।
টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে ১০ মাসে দেশের মানুষকে ১০ কোটি ৩২ লাখেরও বেশি ডোজ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ কোটি ৩২ লাখ ২২ হাজার ২২৩ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন ৬ কোটি ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩৯ জন। ৩ কোটি ৭২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৮৪ জন দুই ডোজ করে টিকা নিয়ে তাদের কোর্স পূর্ণ করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ইতোমধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশের বেশি মানুষ এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। পাশাপাশি ২২ শতাংশের বেশি মানুষ দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন।
চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ কোভিড-১৯ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। পাশাপাশি বর্তমানে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদেরও টিকার আওতায় আনা হয়েছে।
এ ছাড়া করোনার নতুন আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে দেশে বুস্টার ডোজ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। ১৯ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর মহাখালী বিসিপিএসএ প্রতিষ্ঠানে বয়স্ক এবং ফ্রন্টলাইনাদের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, গণমাধ্যমকর্মী) দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে।
কোভিড নিয়ন্ত্রণে ১৮ হাজার বেড তৈরি করেছে সরকার। ১২০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে কয়েক হাজার বেডের সঙ্গে অক্সিজেন সংযোগ দেয়া আছে। সারা দেশে ৮০০ ল্যাব স্থাপিত হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে প্রায় বিনামূল্যে (১০০ টাকায়) সারা দেশে করোনার টেস্ট করানো হচ্ছে। নিয়োগ হয়েছে ১৫ হাজার ডাক্তার, ২০ হাজার নার্স।
সরকারের নানা উদ্যোগে বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বর্তমানে অনেক উন্নত দেশের চেয়ে অনেক কম। জনসংখ্যার হিসাবে পৃথিবীর অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশ কোভিড নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফলতা দেখিয়েছে।
কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার উদাহরণ বাংলাদেশ : সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলা করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার উদাহরণ হয়েছে। সব হাসপাতালে এখন অক্সিজেন সাপোর্ট আছে। সংক্রমণ কমে গেছে। এটা ধরে রাখতে হবে।’
মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকা কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ৭ কোটি, যা শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ পেয়েছে। আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৪ কোটি, শতকরা হিসাবে তা ৩০ ভাগ।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের টার্গেট ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া। এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৩০ ভাগ মানুষকে।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘ওমিক্রন বিশ্বের ৯০টি দেশে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশেও ধরা পড়েছে। কিন্তু মানুষ মাস্ক পরছে না এবং স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না। এ জন্য ওমিক্রন বাড়ার আশঙ্কা করছে সরকার। সারাদেশের মানুষ যাতে আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, এ জন্য জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।’
বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীও মালদ্বীপ যাবেন। বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিতে চায় মালদ্বীপ। এই সফরে এ ব্যাপারে চুক্তি করবে দুই দেশ।