নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া, সন্দ্বীপ থেকে পাহাড়ের দূর্গমে এবং চরাঞ্চলের বাসিন্দারাও এখন বিদ্যুতের আলোও আলোকিত। কিছুদিন আগেও যেসব এলাকার বাসিন্দারা নিজেরাই বিদ্যুতের আলো দেখতে পাবেন আশাবাদী ছিলেন না।
সারা দেশে (৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৯৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। দু’একটি জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু গ্রাহক রয়েছে যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলমান। এরমধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দ্বীপাঞ্চলে । যাদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে শিগগিরই। অর্থাৎ শতভাগ বিদ্যুতায়ন এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বিষয় মাত্র। সে কারণে ২০২১ সাল বিদ্যুৎ খাতের জন্য মাইলফলক।
১৯০১ সালে ৭ ডিসেম্বর আহসান মঞ্জিলে লাইট জ্বালানোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের পথচলা, ১৯১৯ সালে ‘ডেভকো’ নামক ব্রিটিশ কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকায় সীমিত আকারে বিদ্যুৎ বিতরণ শুরু, পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে ঢাকার পরীবাগে ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ধানমন্ডি পাওয়ার হাউস’ নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ বিতরণ শুরু ইতিহাস যেমন মুছে ফেলা যাবে না। তেমনি বিদ্যুৎ খাতের শতভাগ অর্জনও বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
বিদ্যুতের আলো পৌঁছে যাওয়ায় দুর্গম এলাকার অর্থনৈতিক চিত্রও বদলে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক কেন্দ্র, বসছে চাউল কল, স-মিল, অটোমোবাইলের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বেরিয়ে আসছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান।একটি বিদেশি গবেষণায় বলা হয়েছে গ্রামে বিদ্যুতায়নের ফলে বাংলাদেশের শিশুদের গড় উচ্চতা বেড়ে গেছে। প্রায় দুই বছরজুড়েই করোনা মহামারি সত্ত্বেও এই অর্জন সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেছেন এই খাতের বোদ্ধারা।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে যে ঘোষণা দিয়েছেন। তখন অনেকেই একে নির্বাচনী স্ট্যান্ডবাজি বলে মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালকে সে সব সমালোচকদের মুখে চুন-কালি লেপনের বছর বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ র্পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সিস্টেম লসে লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এক সময় ৩৭ শতাংশ সিস্টেম লস ছিল, সেই সিস্টেম লস এখন এক অংকে নেমে এসেছে অনেক বিতরণ কোম্পানিতে। চলতি অর্থ বছরে (২০২১-২২) এর প্রথম ৩ মাসে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিস্টেম লস ছিল ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, একই সময়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি ৫ দশমিক ২০ শতাংশ, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ ও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশে নেমে এসেছে। সামগ্রিক সিস্টেম লস ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
তুলনামূলক সিস্টেম লস বেশি হয়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি। ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, চলতি অর্থ বছরের প্রথম কোয়ার্টারে গীষ্মমৌসুম থাকায় সিস্টেম লস কিছুটা বেশি হয়েছে। আশা করছি পুরো অর্থবছরে গড় সিস্টেম লস লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই থাকবে।
তিনি বলেন, ৫ লাখ গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনার কাজ চলছে। আরও একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যাতে ১২ লাখ গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটার দেওয়া হবে। এই কাজটি শেষ হলে সিস্টেম লস অনেক কমে আসবে।
সিস্টেম লস কমানোর পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও গ্রাহক সেবার মান বাড়াতে কাজ শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সিস্টেম অ্যাভারেজ ইন্টারেপশন ডিউরেশন ইনডেক্স (সাইদি) ও সিস্টেম অ্যাভারেজ ফিকোয়েন্সি ডিউরেশন ইনডেক্স (সাইফি) কঠোর ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। অতীতে এই সুচকগুলো ম্যানুয়ালি হিসাব করা হতো। তখন সংস্থাগুলোর তথ্য গোপন করার সুযোগ থেকে যেতো। সাইদি-সাইফি অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে করে গোজামিল দেওয়ার আরও কোনো সুযোগ থাকবে না। গ্রাহকের সঠিক চিত্র উঠে আসবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আগে সাইদি-সাইফি ছিল বিতরণ কোম্পানি নির্ভর। এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে ডাটা জেনারেট করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। চলতি বছরেই ৫০ শতাংশ অটোমেশন হবে। সবাই কোয়ালিটি ও নিরিবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবে, শিল্পে ডাবল সোর্স নিশ্চিত করা হচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও বিদ্যুৎ নিয়ে হাহাকার ছিল, লোডশেডিংয়ের অভিযোগ ছিল নিত্যদিনের চিত্র। গীষ্মমৌসুমে ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্টসহ নানারকম কৌশল নিতে হতো। বিদ্যুৎ দিতে না পেরে শিল্পে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন সরকারের হাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ২০১৮-২০১৯ সালেও বিদ্যুৎ চালিত অটো রিকশা বন্ধে গলমঘর্ম হলেও এখন বিদ্যুৎ বিভাগেই চায় বৈদ্যুতিক বাস আমদানি উন্মুক্ত করা হোক।
জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বছরজুড়েই গুঞ্জন ছিল বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির খবর। শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনেই থেকে গেছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর খবর টি। কমে এসেছে লোডশেডিংসহ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রবনতা। সারপ্লাস উৎপাদন থাকলেও এখনও নানা সীমাবদ্ধতার কথা বলে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য আরও কিছুটা সময় চেয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেছেন, এতদিন সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো ছিল অগ্রাধিকার। সেই কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুতের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।
প্রিপেইড মিটারে এগিয়ে বিদ্যুৎ, পিছিয়ে গ্যাস : বিদ্যুতে প্রতিদিনই প্রিপেইড মিটার স্থাপন হচ্ছে। গ্যাসে আটকে আছে বেশিরভাগ কাজ। বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনে খুব একটা আগ্রহীও নয়। অভিযোগ রয়েছে— বিতরণ কোম্পানি যেকোনও মূল্যে কাজটি ঝুলিয়ে রাখতে চায়।
কারণ জানতে চাইলে বিতরণ সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, প্রিপেইড মিটার ছাড়া একজন গ্রাহককে দুই চুলার জন্য মাসে ৯৫০ টাকা বিল দিতে হয়। কিন্তু একটি ছোট পরিবারের জন্য প্রিপেইড মিটারে মাসিক খরচ গড়ে ৬০০ টাকা। প্রিপেইড মিটার লাগালে অপচয় কমবে ঠিকই, তবে বিতরণ কোম্পানির লাভ হবে না।
বিতরণ কোম্পানি সূত্র বলছে, আবাসিকে গ্যাসের যে বিল নেওয়া হয় তাতে বিবেচনা করা হয় একটি চুলা একটানা ১২ ঘণ্টা জ্বলবে। অথচ একটি পরিবারের তিন বেলার খাবার রান্নায় বড়জোর দিনে ৬ ঘণ্টা চুলা জ্বালাতে হয়। কিন্তু বিল দিতে হয় ১২ ঘণ্টার হিসাবেই।
গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী মোহম্মদপুরের বাসিন্দা শাকিলা ইয়াসমিন বলেন, ‘গতমাসেই মিটার বসিয়েছে তিতাস। এখন বিল খুব কম আসছে। আমাদের দুজনের সংসার। আগে যেখানে ৯৫০ টাকা দিতাম, সেখানে এখন মাসে ৪০০-৫০০ টাকা লাগছে। সবাইকে প্রিপেইড মিটারই দেওয়া উচিত। এতে গ্যাসের অপচয়ও কমবে।’
সরকারের পরিকল্পনা হলো, ২০২২ সালের মধ্যে দেশের সকল গ্যাস গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা। কিন্তু সেখানে সবচেয়ে বড় কোম্পানিটির উদ্যোগও হতাশাজনক।
অনুসন্ধনে জানা গেছে, বিদ্যুৎ বিতরণকারীরা ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯৪টি প্রিপেইড মিটার স্থাপন করেছে। পরিকল্পনা থেকে ঢের পিছিয়ে থাকলেও বলা হচ্ছে এই সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কিন্তু গ্যাসে কতটি মিটার স্থাপন হয়েছে তা প্রকাশ করতেও সংকোচ বোধ করছে জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে দেশের সব এলাকার আবাসিক গ্যাস গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটার দেওয়া হবে। এই পরিকল্পনা ধরেই বিতরণ কোম্পানিগুলো কাজ করছে। তবে পরিকল্পনার আংশিকও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
জাপান সরকারের ৩৫তম ওডিএ ঋণ প্যাকেজভুক্ত প্রাকৃতিক গ্যাস সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্প-এর অধীনে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩ লাখ ২০ হাজার প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন হওয়ার কথা রয়েছে। জিওবি, জাইকা এবং টিজিটিডিসিএল (নিজস্ব)-এর ৭৫৩ কোটি টাকা অর্থায়নের ‘প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন’ প্রকল্পটির মেয়াদ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত।
তিতাস জানায়, প্রথম পর্যায়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ২ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ লাখ ২০ হাজার মিটার ক্রয় ও স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।
২০২০-২১ অর্থবছরে ১০টি লটে ৬৩ হাজার ৩৬০টি মিটার জাপান থেকে আসে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাৎসরিক কর্মসম্পাদন চুক্তি অনুযায়ী জুন ২০২১ এর মধ্যে ৫০ হাজার মিটার স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। বিপরীতে মিটার স্থাপন হয় ৫৫ হাজার ৩৪৫টি।
তিতাসের মোট আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৭ জন। বর্তমান গতিতে মিটার লাগানো হলে এক যুগেও সবার আঙিনায় প্রিপেইড মিটার বসবে না। এদিকে ২০৩০ সালের পর দেশীয় গ্যাস পাওয়া নিয়েও সন্দিহান সরকার। অর্থাৎ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের আগেই চুলাগুলো গ্যাস শূন্য হয়ে যেতে পারে।
গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের উপমহাব্যবস্থাপক (ইনস্টলেশন অফ প্রিপেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএল) প্রকৌশলী মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘তিতাস সরাসরি কাজটি করছে না। জাইকার অর্থায়নে এখন ৩ লাখ ২০ হাজার মিটার স্থাপন করা হচ্ছে। বেশিরভাগই স্থাপন হয়েছে। কিছু বাকি।’
গ্রাহকের তুলনায় মিটার এত কম কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অর্থায়নের কারণেই ধাপে ধাপে মিটার স্থাপনের কাজ চলছে। আবার গ্রাহক নিজে চাইলেও মিটার কিনে বসাতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক বরাবর আবেদন করতে হবে। এরপর মিটার কিনে তা বিতরণ এলাকার অফিসে জমা দিলে মান যাচাই করে স্থাপন করার উদ্যোগ নেবে তিতাস।’