দুর্নীতিবাজরাই দুর্নীতির তদন্তকারী!

বিশেষ প্রতিবেদন

আমাদের কাছে যত অভিযোগ আসে তা মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তার মাধ্যমেই তদন্ত করা হয়। সেক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ প্রমানিত হয় তবে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
বেলাল হোসাইন, পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি জান্নাতুল মাওয়া। কিন্তু ২০১৫ সালে অনৈতিকভাবে যোগদান দেখিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর দীর্ঘ ৫বছরে একদিনের জন্যও স্কুলেও আসেননি তিনি।
অথচ ২০২০ সালের এমপিও শিটে নাম উঠেছে এই শিক্ষিকার। শেষমেষ এ বছর থেকে সরকারি টাকা (এমপিও) ভোগ করছেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার খাসকররা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাধিক শিক্ষক এভাবে অনিয়ম করে সরকারি অর্থ ভোগ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী এই দুর্নীতির দায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা অফিস এড়াতে পারেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বিষয়ে অভিযোগ ও একাধিক সংবাদ প্রকাশের পরও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জেলা শিক্ষা অফিস। সর্বশেষ দুদকে এ ঘটনায় অভিযোগের পর মাউশি তদন্তে পাঠিয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে যারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তারাই তদন্ত করবেন।
জানতে চাইলে মাউশি খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালক আব্দুল খালেক বলেন, এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আমার নজরে আসে। আমি চুয়াডাঙ্গা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, এমপিওভুক্তিতে কোনো অনিয়ম হয়নি।
মাউশির আঞ্চলিক অফিসগুলোতে এভাবেই দুর্নীতির বিস্তার চরমভাবে বেড়েছে। শিক্ষাভবনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যেন কলা পাতাকেও এমপিও দেয়া হচ্ছে।
জানা যায়, ক্ষমতা বিক্রেন্দ্রীকরণ ও সেবা সহজ করতে ২০১৫ সালে এমপিও ব্যবস্থা মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলো সরকার। কিন্তু ওপরউক্ত দুজনের মতো সারাদেশের হাজারো শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।
এছাড়া ভুয়া এমপিও ভুক্তিসহ শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটি এমনকি জেলা, উপজেলা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের বিরুদ্ধেও শত শত লিখিত অভিযোগ জমা পড়ছে মাউশিতে। দেখা যাচ্ছে, যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের দিয়েই এসব অভিযোগের তদন্ত কাজ করানো হচ্ছে। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো সময়, শ্রম ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে সরকারের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের।
মাউশির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কলাপাতা, কাঁঠালপাতাকেও এমপিও দিচ্ছে মাউশির আঞ্চলিক কর্মকর্তারা। আর শত শত অভিযোগ আসছে আমাদের কাছে। আমরাতো ঢাকা থেকে গিয়ে তদন্ত করতে পারি না। আমরা দায়িত্ব দেই আঞ্চলিক কার্যালয়ে। দেখা যাচ্ছে যে কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে ভুয়া এমপিও দিয়েছেন তিনিই এই অভিযোগের তদন্ত করছেন।
জানা যায়, মাউশি ছাড়াও গত তিন বছরে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ২৪৪টি দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। এর মধ্যে নানা সময়ে ১৮৪টি অভিযোগ তদন্তে মাউশিকে দায়িত্ব দিয়েছিলো সংস্থাটি। কিন্তু পরে তদন্তের অগ্রগতি ও প্রতিবেদন পাঠাতে ৪০টি চিঠি মাউশিকে পাঠায় দুদক। কিন্তু কাজ না হলে বাধ্য হয়ে গত বুধবার মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুককে তবল করে দুদক।
কর্মকর্তারা বলছেন দুদক থেকে যেসব অভিযোগ মাউশিতে পাঠানো হয় তার কোন রেকর্ড রাখা হয় না। তবে সম্প্রতি মাউশি মহাপরিচালককে দুদকে তলব করায় এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে চলেছে মাউশি।
এদিকে মাউশির উর্ধতন একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন করার শর্তে বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই ছোটখাটো এসব দুর্নীতি তদন্তে বছরের বছর সময় লাগছে। কারণ মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার যোগসাজশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি সংগঠিত হয়। অনেকক্ষেত্রে সরকারের কিছু কর্মচারি- কর্মকর্তাও এসব কা-ে জড়িত। কিন্তু আমাদের হাতে তো উপায় নাই, ফলে তাদেরকেই দিয়েই তদন্ত করাতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক এমপিওভুক্তি, নিয়োগসহ নানা খাতে যে দুর্নীতি বেড়েছে বিষয়টি সম্প্রতি উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে।
সংস্থাটি বলছে, শিক্ষক এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বেলাল হোসাইন বলেন, আমাদের কাছে যত অভিযোগ আসে তা মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তার মাধ্যমেই তদন্ত করা হয়। সেক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ প্রমানিত হয় তবে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
তিনি বলেন, আপনি যেটা বলছেন মাঠ পর্যায়ে যারা অনিয়ম করে তাদের দিয়েই তদন্ত করানো হয় এটা সত্যি, কিন্তু এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ আমাদের নেই।
দুর্নীতি নির্মূলে এটি কোন সীমাবদ্ধতা কিনা, এমন প্রশ্নে বিষয়টিকে সরকারের নিয়ম বলে উল্লেখ করেন তিনি।