অভিযোগের প্রতিকার নেই
বিশেষ প্রতিবেদক : কাকরাইল থেকে ইস্কাটন আসবেন বলে পাঠাওয়ের অ্যাপে বাইকের জন্য রিকোয়েস্ট দিয়েছিলেন আল ফারুক। একজন বাইকার সেটি গ্রহণ করেও তিনি পরে তা ক্যানসেল করেন। ফলে সেটি যায় আরেকজন বাইকারের কাছে। কিন্তু তিনি কলও করেন না, আবার জনাব ফারুক কল করলেও ধরেন না।
পরে হেঁটেই গন্তব্যে আসেন ফারুক। আর আসার পর মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ আসে, তার যাত্রা শেষ হয়েছে, তিনি যেন ৮১ টাকা ভাড়া পরিশোধ করেন। হতবাক ফারুক অ্যাপের ম্যাসেজে লিখেন, পুরো ঘটনাটি কী ঘটেছে। বাইকার তার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে অন্য একজন যাত্রীকে চুক্তিতে নিয়ে গেছেন অন্য পথে।
অভিযোগটি করার চারদিন পরেও পাঠাওয়ের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা পাঠানো হয়নি ফারুকের কাছে। ফলে তিনি জানতে পারেননি ওই বাইকারের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না। এর আগে ‘সহজ’ এর এক বাইকারের বিরুদ্ধে অ্যাপে অভিযোগ দিয়েও সুফল পাননি তিনি।
গাড়ি ভাড়া করা নিয়ে চরম ভোগান্তির রাজধানীতে ২০১৬ সালে অ্যাপনির্ভর সেবা চালু হওয়া আশীর্বাদ হয় যাত্রীদের জন্য। প্রথমে মোটর সাইকেল ভাড়ার সেবা নিয়ে আসে স্যাম নামে একটি কোম্পানি। পরে আন্তর্জাতিক কোম্পানি উবার নিয়ে আসে গাড়ি ভাড়া সেবা। দেশি কোম্পানি পাঠাও নিয়ে আসে মোটর সাইকেল সেবা। ধীরে ধীরে গাড়ির পাশাপাশি মোটর সাইকেল ভাড়ার সেবা দিতে থাকে ১৬টির মতো প্রতিষ্ঠান।
শুরুর দিকে যাত্রীর চাহিদামতো গন্তব্যে অ্যাপ নির্ধারিত ভাড়ায় চালকরা যেতে রাজি থাকলেও ইদানীং সিএনজিচালিত অটোরিকশার রোগ ভর করেছে তাদের ওপরও। বিশেষ করে বাইকাররা ‘পোষায় না’ বলে চুক্তিতে যেতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে যাত্রীদের। আবার যাত্রীর গন্তব্য পছন্দ না হলে রিকোয়েস্ট ক্যানসেল করে দিতে বলার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
এতে যে কেবল যাত্রীরা হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন তা নয়, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারও। কারণ, গাড়ির মালিকের কাছ থেকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে অর্থ পায়, তার পাঁচ শতাংশ সরকারি কোষাগারে যায়। কিন্তু, চালকরা চুক্তিতে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ পাচ্ছে কম, আবার তা থেকে সরকারি খাতাতেও হিসাবে পড়ছে কম।
এরই মধ্যে সেবাদানকারী কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কোম্পানিগুলো আবেদন করেছে আর নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে একটিকে।
একটি খসড়া নীতিমালার অধীনে দেওয়া হচ্ছে এই নিবন্ধন। আর এই খসড়ায় বলা আছে, কোম্পানিগুলো যাত্রীদের অভিযোগ জমা দিতে হেল্পলাইন করবে। কিন্তু শেয়ার রাইডিং কোনো কোম্পানিই এই কাজ করেনি।
বিভিন্ন কোম্পানির অ্যাপে অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ থাকলেও এই পদ্ধতি একেবারেই কার্যকর নয়। আর এটি এত জটিল যে যাত্রীরা ভুগলেও অভিযোগ করতেই চান না।
নানা অনিয়ম আর সরকারের রাজস্ব বঞ্চনার বিষয়ে জানতে রাইড শেয়ার রাইডিং সেবা দেওয়া একাধিক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলে। অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য দিতে সব সময় অনীহা দেখিয়েছে কোম্পানিগুলো। এমনকি সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও প্রশ্নের জবাব না দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।
পাঠাওয়ের গণমাধ্যম শাখার কর্মকর্তা নাবিলা মাহবুবের কাছে এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলেন, আপনার প্রশ্ন পাঠান। পরে প্রশ্ন ই-মেইল করা হলেও তিনি কোন জবাব দেননি।
উবারের পিআর প্রতিষ্ঠান বেঞ্চমার্ক পিআর কোম্পানি গণমাধ্যম কর্মকর্তা আশরাফ কাইছারের কাছে এসব বিষয় জানতে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। প্রশ্ন পাঠালে সেটা উবার কোম্পানিকে পাঠাব তারাই এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম বলেন, রাইড শেয়ারিংয়ের কোন নীতিমালা নেই, একটা খসড়া আছে। নীতিমালা না থাকলে আমরা কোনো কিছুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারি না। কারণ তাদের কোন আইনের আওতায় আনব? তাই এটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ হচ্ছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশে যে সার্ভিস চালু হোক না কেন তা আইনের অপপ্রয়োগের কারণে কিছু ‘নিয়ম’ কার্যকর করা যায় না। নিয়ম মধ্যে থেকে হঠাৎ কোন যানবাহন যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে আর তার বিরুদ্ধে যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়, তাহলে সবাই সতর্ক হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে রাত বারোটা রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, কিন্তু একটা থাকলেও সেটা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ গাড়ির চালক জানে, নিয়ম ভাঙলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই কারণে তারা ভয় পায়। কিন্তু আমাদের এখানে সব ভিন্ন চিত্র।
কোন রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান অ্যাপে চলল বা খ্যাপে চলল তাতে ভাববার কেউ আমাদের এখানে নেই। যাত্রীকল্যাণের সদস্য হিসেবেও এটা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমরা তাদেরকে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছি। উবারসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির যে টার্ম- কন্ডিশন (শর্ত) ছিল সেগুলো আমরা পরিবর্তন করিয়েছি। এগুলোতে তাদের ভিন্নমত ছিল। কিন্তু আমরা বলেছি- আইনের বাইরে আমরা কিছু করছি না।
কেউ যদি আলাদাভাবে অভিযোগ করে তাহলে আমরা দুইপক্ষকে ডেকে শুনানি করব। তাছাড়া ভোক্তা অধিকারে হটলাইন আসার প্রক্রিয়া চলছে। ৯৯৯-এ কল দিলে আমাদের নম্বর দিয়ে দেয়। তখন আমরা রাইড কোম্পানির কাছে অভিযোগ জানাতে যাত্রীকে কোম্পানির ইমেইল এড্রেস বা যোগাযোগের সব বলে দেব।
অনেক সময় আমরাও এসব কোম্পানির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়ে থাকি। আর অফিসে তো প্রতিনিয়ত যাত্রীরা হয়রানির অভিযোগ করছে। শুনানি হয়ে অনেককে জরিমানাও করা হয়েছে। হয়রানি বন্ধ করতে আমরা কাজ করছি, কোম্পানিগুলোকেও সতর্ক করা হচ্ছে।