অর্থনৈতিক প্রতিবেদক ঃ পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ফলে ঈদ ঘিরে বেড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। ঈদের আগের সাত দিনে ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ইউএস ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা) এ অর্থের পরিমাণ আট হাজার ৪৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এ হিসাবে ঈদের আগে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স এলেও মূলত ৩১টি দেশ থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিট্যান্স আসে।
তবে ঈদে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়লেও গত অর্থবছরে (২০২১-২২) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটির মতো প্রবাসী দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ১৫.১২ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স। অর্থাৎ এবার রেমিট্যান্স কম এসেছে ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আসে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ, মার্চে ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ, এপ্রিলে ২০১ কোটি আট লাখ, মে মাসে আসে ১৮৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এবং সর্বশেষ জুন মাসে এসেছে ১৮৩ কো?টি ৭২ লাখ ডলার।
এদিকে রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় রেমিট্যান্সের। মূলত বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আসার প্রধান দুটি দেশ সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। গত অর্থবছরে এ দুটি দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এতে চাপ পড়েছে রিজার্ভে।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স কমেছে পৌনে চার বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকেই কমেছে সোয়া দুই বিলিয়ন ডলার। শতকরা হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমেছে সিঙ্গাপুর থেকে। তৃতীয় অবস্থানে তেলসমৃদ্ধ আরবের দেশ ওমান।
শতকরা হিসাবে ২০ শতাংশের মতো পতন হলেও টাকার অঙ্কে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি কমেছে সৌদি আরব থেকে। এদিকে মালয়েশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে ৫০ শতাংশ।
মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স এত বেশি কমার কারণ সম্পর্কে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, এই দেশগুলো থেকে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে আসে। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকায় হুন্ডিও বন্ধ হয়ে যায়। তখন সব টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। সে কারণে ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আবার আগের মতো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় বেশি টাকা পাওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন তাঁরা। সেই কারণে এই দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কম আসছে।
দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। রেমিট্যান্স বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশ করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাঁদের বড় অংশই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, কাজ করছে বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নিরসনে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধারাবাহিকভাবে কমাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। এই রেটেই রেমিট্যান্স বিনিময় করা হয়।
তবে বিভিন্ন ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো আমদানি বিলের জন্য নিচ্ছে ৯৪ থেকে ৯৫ টাকা, নগদ ডলার বিক্রি করছে ৯৬ থেকে ৯৭ টাকায় আর ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৮ থেকে ৯৯ টাকায়।