অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ ঋন শব্দটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক শব্দ। এই শব্দটির সাথে যখন “ফাঁদ” শব্দটি যুক্ত হয় তখন এর ক্ষমতা এতটায় বেড়ে যায় যে শুধু কোন ব্যাক্তি নয় বরং একটি রাষ্ট্রকে ভীত করে দিতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে বিশৃঙ্খলা। নিকট অতিতে দেউলিয়ার ইতিহাস ঘাটলে যেকটি দেশের নাম আসে তার ভেতর রয়েছে আর্জেন্টিনা, গ্রিস। সম্প্রতি দেউলিয়া হয়েছে লেবানন। ইতালিতেও ভয়ংকর সঙ্কট ছিল। আর দক্ষিণ এশিয়াতে দেউলিয়া শব্দটি বেশ ব্যাবহার হচ্ছে শ্রীলংকার ক্ষেত্রে। অনেকের মনেই প্রশ্ন আসছে একটা দেশ যখন দেউলিয়া হয়ে যায় তখন আসলে কি ঘটে দেশের? এসব বিষয়েই আজকের আলোচনা।
যখন প্রসঙ্গ বাংলাদেশ নিয়ে তখন ঋন নেয়ার কুফল বর্ণনা করতে বহুদেশের কোন ফি লাগেনা। বিনামূল্যে পরামর্শ চলে। ভারতের জনৈক কূটনীতিবিদ কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঋনের কুফল বর্ণনা করে সতর্ক হবার পরামর্শ দিয়েছেন। পশ্চিমা দেশগুলিও পিছিয়ে নেই।ঋন নিয়ে সাধারন মানুষকে ভীত করা যেমন সহজ, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করাও খুব সহজ। বিশ্বাস না হলে রাজনৈতিক ব্যাবহারের কিছু উদাহরন দেয়া যাক।প্রচুর মানুষ পাবেন, বিখ্যাত লেখক পাবেন, স্বনামধন্য মিডিয়া পাবেন, যেখানে বিভিন্ন লেখায় একটি কথা বার বার ব্যাবহার হয়। বাংলাদেশে একটি শিশু জন্ম নিলে শিশুটির ঘাড়ে নাকি ৩৯,০০০ টাকার ঋন (ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত হিসাব অনুসারে) থাকে। কথাটি এত সুন্দর ভাবে একটি শিশুকে সামনে এনে উপস্থাপন করে বলা হয় যেন কোন পাপ না করেই শিশুটিকে খেলাপী ঋনের জন্য জেলে যাওয়া লাগতে পারে। মজার বিষয় রয়েছে এখানে। যখন একটি শিশুর জন্মের সাথে ঋনের অঙ্কটি বলা হয় তখন কোন কলামিস্টের লেখায় পাশাপাশি উল্লেখ পাবেন না যে সেই নিষ্পাপ শিশুটির জন্মের সাথে সাথে তার নামে আয় ২,২২,১৫৮ টাকা (২৫৫৪ ডলার@৮৭বিডিটি) রয়েছে সেটি বলার। সুচিন্তিত ভাবে মানুষকে ভীত করার জন্য এবং রাজনৈতিক ব্যাবহারের উদ্দেশ্যেই এটা করা হয়। কেউ সচেতন মনে করেন। কেউ বা অবচেতন মনেই। বাস্তবতা হল, শিশুটি আয় ও করেনা, ঋন ও নেয়না। তাই সামগ্রিক অর্থনীতির সুচক গুলাকে এভাবে ব্যাবহার করা ঠিক না।
ঋনের ক্ষেত্রে সবাই যেমন দাবি করে আমার ঘাড়ে (একটি শিশুর ঘাড়ে) কেন এত টাকার ঋন থাকবে? আবার মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রেও দাবি করে আমার টাকা কই গেল? সামস্টিক অর্থনীতির উপাত্তগুলিকে এভাবে ব্যাবহার করা যায় না সেকথা কেউ বলবে না। এখানে আবার আরেকটি ব্যাপার স্পষ্ট। ঋনের হিসাবের সংখ্যা সকলে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করলেও আয়ের হিসাবের ক্ষেত্রে কেউ বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনা। এক্ষেত্রে শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রচুর মানুষের সাধারন বিশ্বাস এমন যে মাথাপিছু আয় ২,২২,১৫৮ টাকা হল মাসিক আয়। আর তখন হিসাব মেলানো শুরু হয় আমার টাকা কই গেলো। এটাকে ১২ দিয়ে ভাগ করে মাসিক আয় পড়ে ১৮৫০০ টাকা, আর ঋন পড়ে ৯২৮ টাকা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঋনের রাজনৈতিক ব্যাবহার বেশ পুরানো। ব্রেটন উড চুক্তির মাধ্যমে জন্ম নেয়া বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের নামে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর ইতিহাস আছে। মূলত পশ্চিমা দেশগুলির এজেন্ডা বাস্তবায়নের বেশ সফল হাতিয়ার গুলির একটি হল ঋন। নিকট অতিতেও বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়নের আগে অর্থমন্ত্রীদের প্যারিস সফর করা লেগেছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের মিটিং এ। উন্নত দেশগুলিকে বলা হয় দাতা দেশ। তাদের প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করত বাজেটের অনেক কিছু। দরকষাকষি চলত তাদের কি কি নতুন শর্ত বাংলাদেশ মানবে অথবা মানবে না। এই দাতা দেশের ক্লাবটির নাম প্যারিস ক্লাব। ২২ টি দেশ এর সদস্য। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে সহ মোট ২২ টি দেশের এলিট প্যারিস ক্লাবের দেশগুলি থেকেই গরীব দেশগুলি ঋন নিত। অনুন্নত ও সল্প উন্নত দেশগুলির বৈদেশিক সাহায্যের উৎস বলতেই বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ অথবা বৃহৎ দাতা দেশগুলি। এছাড়া আর কোন উপায় কারো হাতে ছিলনা। আর এই সুযোগেই বিভিন্ন ভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে এসব দেশের উপর। বাংলাদেশকেও দেখতে হয়েছে অসংখ্য শর্ত। আদমজী পাটকল বন্ধ করে দাও, কৃষি ও বিদ্যুতে সাবসিডি তুলে নাও এরকম বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আটকে অবশেষে অনেক শর্তই পরিপালন করতে হত।কিন্তু সমস্যা হল, যখন এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা এলিট দাতা গোষ্ঠীর বিকল্প হিসাবে আরেকটি পক্ষ সামনে আসে। বিশেষ করে চীন। এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এর মত দাতা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হিসাবে জন্ম হয়েছে AIIB, NDB। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে AIIB এর জন্মের সময় ও পশ্চিমা সমালোচনা ছিল প্রবল। মূল সমস্যা হল, চীন যখন পশ্চিমা সফট পাওয়ার হিসাবে ব্যাবহার হওয়া ঋনের বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে তখন হঠাৎ করেই বিশ্ব মিডিয়ায় খুব ফলাও করে প্রচার চলছে চীনা ঋন ফাঁদে দেউলিয়া হচ্ছে সব দেশ। শ্রীলংকার উদাহরন এখানে আসতে পারে। শ্রীলংকার মোট ঋন $৫১ বিলিয়ন ডলারের ভেতর চীন থেকে নেয়া ঋনের পরিমান মাত্র $৩.৪ বিলিয়ন ডলার, জাপান থেকে নেয়া ঋন $৩.৪ বিলিয়ন ডলার, বিশ্ব ব্যাংক থেকে $৩.২ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলংকার চলতি ঋন শোধ করতে হবে $৭ বিলিয়ন ডলার। এর জন্য দায়ী সভরেইন বন্ডের বেশ কয়েকটির ম্যাচুউরিটি সামনে। কিন্তু শতকরা হিসাবে চীনের ঋনের পরিমান বেশি না হলেও আঘোষিত ভাবে শ্রীলংকা পরিস্থিতির জন্য চীনকে দায়ি করে হয়েছে। ধারনাটি প্রতিষ্ঠাও পেয়েছে। বাংলাদেশকে এখন আরো সচেতন ও সতর্ক হতে বলা হচ্ছে বিশেষ করে চীন থেকে। এর পেছনে মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার দায়ী। আর চীন বা রাশিয়াকে টার্গেট করার পেছনে বাস্তবতার চেয়ে রাজনীতি বড় ভূমিকা রেখেছে। জি-২০ Debt Service Suspension Initiative (DSSI) এর আওতায় ৪১ টি দেশের প্যারিশ ক্লাবের কাছে ২০০৬ সালে ঋন ছিল ২৮% যা ২০২০ সালে কমে হয়েছে ১১%।
একি সময়ে চীনের অংশ বেড়ে ২% থেকে ১৮% হয়েছে। বিষয়টি ঋন ভিত্তিক পশ্চিমা প্রভাব খাটানোর পথে বাধা।
এখানে অবশ্য রাখঢাক না রেখেই চীনের ব্যাপারে সতর্ক হও বলতে কেউ দ্বিধা করেনা।