ধরা পড়বেন প্রভাবশালীরা

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় রাজধানী রাজনীতি

চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে চলছে তথ্য যাচাই

মহসীন আহমেদ স্বপন : রাজধানীতে র‌্যাব-পুলিশের অবৈধ ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতা খালেদ, জি কে শামীম ও কৃষকলীগ নেতা ফিরোজকে রিমান্ডে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দারা। অবৈধ মাদক ব্যবসা, জুয়া চালানো, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধে সহযোগিদের দীর্ঘ তালিকা দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই তালিকা যাচাই-বাচাই করছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। খালেদ মাহমুদের মামলার তদন্তভার র‌্যাবে হস্তান্তর করা হয়েছে বুধবার। এর আগে ডিবি তদন্ত করছিলো মামলাটির। এছাড়া গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহ-সম্পাদক রুপন ভূইয়ার ক্যাসিনোর টাকার সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুই ভাইয়ের বিলাসী জীবনযাপনের তথ্য।
রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সবখানেই এখন আলোচনার শীর্ষে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই অভিযানে একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নাখোশ হলেও সারাদেশের সাধারণ মানুষ অনেক বেশি খুশি। অভিযানে দেশের মানুষ সমর্থন দিচ্ছে। জনগণের কাছে সরকার ও আওয়ামী লীগ উজ্জ্বল হচ্ছে।
দলের আদর্শিক ও ত্যাগী নেতারাও এ ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করে অভিযান অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের দল থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। তবে এই অভিযান আরো বিস্তৃত হবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার স্পষ্ট ঘোষণা, ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি, একে একে সকলকে ধরব।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গডফাদারের নাম চলে এসেছে। তালিকায় অনেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাম এসেছে। এই গডফাদারদের ধরার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চান আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। আগামী ১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরছেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে গডফাদারদের ধরার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
রাজধানীর সাধারণ মানুষ বললেন, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজদের কেউ আর প্রকাশ্যে নেই। কোথায় গেছে? কে জানে এখন কই থাকে কেউ বলতে পারে না। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আত্মগোপনে আছেন অনেক নেতাকর্মী।
অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে ত্যাগী ও দলের পুরোনো নেতাকর্মীরা হুমকিতে থাকেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চায় না কেউ আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করুক। তারা এই শুদ্ধি অভিযানকে স্বাগত জানান।
আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে দলের যেসব নেতাকর্মী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অন্যায়, অপকর্ম, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে সরকার। তবে বিভিন্ন সেক্টরে দাপুটে, বিতর্কিত এবং আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তাদের অধিকাংশই পর্দার আড়ালে চলে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টার্গেটে এবার সরকারদলীয় সুবিধাভোগী বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, পরিবহন চাঁদাবাজ, স্কুল ও কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, কোচিং ব্যবসায়ী, নদী দখলদার, ভূমিদস্যু, বনখেকো, মিথ্যা ঘোষণার অবৈধ মালামাল আমদানিকারকসহ বিভিন্ন শ্রেণির দুর্নীতিবাজরা রয়েছে। শিগগির তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হবে। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউক, শিক্ষা ও বিদ্যুৎ ভবনের ঠিকাদারিতে যারা অনৈতিক প্রভাব রাখতেন, তারাও আছেন নজরদারিতে। এছাড়া আয়ের উৎস না থেকেও অবৈধ সম্পদ অর্জন, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ইতিমধ্যে সমালোচিত হয়েছেন- এমন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধেও বড়ো ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকায় পরিবহনে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রভাবশালী মালিকপক্ষ সরকারের ছাত্রছায়ায় কৌশল বদলে চাঁদার অঙ্ক জিইয়ে রেখেছে। সরকার এবার পরিবহনের চিহ্নিত চাঁদাবাজদের ছাড় দেবে না। ঢাকায় বিভিন্ন রুটের প্রায় ৬ হাজার বাস, মিনিবাস থেকে প্রতি দিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ চাঁদাবাজির নেপথ্যে সরকার সমর্থক প্রভাবশালী চক্র জড়িত। তাদের তালিকাও সরকারের হাইকমান্ডের কাছে। যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানান, কোনো রুটের যানবাহনই চাঁদামুক্ত নয়।
ক্যাসিনো দুই ভাইয়ের বিলাসী জীবন : গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহসম্পাদক রুপন ভূইয়ার ক্যাসিনোর টাকার সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুই ভাইয়ের বিলাসী জীবনযাপনের তথ্য। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের হুমকি দিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়ি লিখে নেয়া থেকে শুরু করে পদ-পদবীও বাগিয়ে নিতেন এই দুই ভাই। আর কোটি কোটি টাকা ও ঢাকা শহরে প্রায় ৫০টি ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক এই দুই ভাই কখনোই কোনো পেশায় যুক্ত ছিলেন না। ক্যাসিনোই তাদের টাকা-পয়সার একমাত্র উৎস। র‌্যাব-৩-এর কমান্ডিং অফিসার(সিও) লে. কর্নেল কে এম শফিউল্লাহ বলেন, র‌্যাব এখন পর্যন্ত এনু ও রুপনের ১৫টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে ক্যাসিনোর টাকা দিয়ে তারা গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৫০টির মতো বাড়ি কিনেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সেকেন্দার আলী নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, বানিয়ানগরের ১০ তলা ভবনটির পুরোটাই ব্যবহার করছেন দুই ভাই এনু ও রুপন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দুই ভাই রাজকীয়ভাবে থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো কাউকে ভাড়া দেয়া হয় না। এর মধ্যে কয়েকটি ফ্ল্যাটে থাকেন এনু-রুপনের আত্মীয়-স্বজনরা। তারা মূলত দুই ভাইয়ের সহযোগী হিসেবেই কাজ করেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন অফিস হিসেবে। এছাড়া রয়েছে নাচ-গানের একটি স্টুডিও। মিটিংয়ের জন্য রয়েছে আলাদা ফ্ল্যাট। সুবাস নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এই ভবনের ভেতরে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা আসতেন। অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাও আসতেন। র‌্যাব সদস্যরা সোমবার ভোরে এই বাসায় অভিযান চালিয়েছে। অভিযানের পর বাইরে থেকে তালা লাগানো হয়েছে।
ক্যাসিনোর জুয়াড়িরা জেলে মাদক মামলায় : দেশে জুয়া বিরোধী একটি আইন থাকলেও রাজধানীতে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে আটক শতাধিক ব্যক্তির কারও বিরুদ্ধেই ওই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ নামের যে আইনটি রয়েছে সেটি রাজধানীতে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে ইহা প্রযোজ্য হইবে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। রাজধানীর ক্লাবগুলো থেকে জুয়া এবং ক্যাসিনোর বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হলেও আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তা বলছেন, ‘দুবল’ আইনের কারণেই আটকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই।
লাপাত্তা জড়িত নেপালিরা : ঢাকার এসব ক্যাসিনো পরিচালনার শুরু থেকেই নেপালি নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা ক্যাসিনোর বোর্ড পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিতেন। তবে এখন পর্যন্ত একজন নেপালি নাগরিককেও আটক করতে পারেনি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযান শুরুর দিন থেকেই জড়িত সব নেপালি গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের সন্ধানে বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে তাদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *