মহসীন আহমেদ স্বপন : সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ডিসি, এসপি, ইউএনও-ওসিসহ মাঠ প্রশাসকের সকল কর্মকর্তার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে নজরদারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের কর্মমূল্যায়ন ও অফিস ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাছাড়া মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দৈনন্দিন কর্মমূল্যায়নের জন্য পৃথক পৃথক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকে মাঠ প্রশাসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। একই সাথে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে যথাসময়ে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অফিসে উপস্থিত থাকার বিষয়ে তদারকি নিশ্চিত করা, জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের প্রত্যেক কর্মকর্তাকে প্রতি তিন মাসে একটি করে বছরে ন্যূনতম চারটি জেলা ও উপজেলা পরিদর্শন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে মাঠপ্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার কর্মকা-ে প্রশাসন যন্ত্রকে ধাক্কা দিয়েছে। সেজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ডিসি, ইউএনও, এসিল্যান্ডসহ মাঠ প্রশাসনের সার্বিক কর্মকা- শতভাগ কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে চায়। ওই লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্তরে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিদ্যমান নির্দেশনা অনুযায়ী ডিসিসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত অফিসে অবস্থান করছেন কিনা তা প্রতিদিন মনিটরিং হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। ডিসি বা ইউএনও ওই সময় বিশেষ জরুরি কোনো কাজে অন্য কোথাও থাকলে তাও যাচাই করে দেখা হচ্ছে। যদিও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ফলে পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও উৎকর্ষ বিকাশের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে হয়রানি হওয়ারও সুযোগ থাকে। তবে কোনো কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় শাসনের পরিপন্থি কোনো কাজে জড়িত কিনা সেজন্য এর প্রয়োজন রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ডিসিদের কর্মমূল্যায়নের জন্য বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) ও গোপনীয় প্রতিবেদনসহ (এসিআর) বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। সরকার ওসবের মাধ্যমে ডিসিদের কর্মমূল্যায়ন করে থাকে। তাছাড়া সম্প্রতি দৈনন্দিন কার্যক্রম তদারকি করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মূলত সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসকদের তদারকি করা হচ্ছে। আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইউএনওদের তদারকি করা হচ্ছে। এভাবে প্রত্যেক দপ্তরপ্রধান অধস্তনদের তদারকি করছেন।
সম্প্রতি ক্যাসিনো-জুয়া, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা ইস্যুতে সমালোচিত হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যরা। তবে সেবার বিনিময়ে টাকা গ্রহণ, দীর্ঘদিন থানার ওসি থেকে আধিপত্য বিস্তার নিয়েও বিব্রত সংস্থাটি। ক্যাসিনোকা-ে প্রাথমিকভাবে কয়েকজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত ও বদলি করা হয়েছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিলের ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে নারী-পুরুষসহ ১৪২ জনকে আটক এবং ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা জব্দ করে র্যাব। অথচ ক্লাবটিতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলছিল ক্যাসিনো। মতিঝিল থানা থেকে যার দূরত্ব সর্বোচ্চ ১০০ গজ। অভিযানের পর মতিঝিল থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকার ক্রীড়া ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর চারদিন পর মতিঝিলের চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় মতিঝিল থানা পুলিশ। বন্ধ করে দেয় আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। নাকের ডগায় বছরের পর বছর ক্যাসিনো চললেও কেন এত দেরিতে অভিযান, এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
এ বিষয়ে মতিঝিলের স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, জুয়ার একটা অংশ নিয়মিত যেত মতিঝিল থানা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার পকেটে। তবে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মতিঝিল থানা পুলিশের ওসি (সদ্য বদলিকৃত) ওমর ফারুক। জানতে চাইলে মতিঝিলের উপ-কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের কাছে খবর আসামাত্র অভিযানে যাই। কতদিন ধরে চলছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত- এসব বিষয় তদন্ত করে দেখব।
মতিঝিল পুলিশ ‘না জানার ভান’ করলেও তার চেয়েও বড় অপরাধ করেছে পুলিশের দুই কর্মকর্তা। ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে একদিকে যখন মতিঝিল ও গুলিস্তানের ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালাচ্ছিল র্যাব, একই সময়ে সেগুনবাগিচার একটি ভবন থেকে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী ১৩ নেপালি নাগরিককে পালাতে সাহায্য করে পুলিশের ওই দুই সদস্য।
এখানেই সমালোচনার শেষ নয়। ২৩ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের অভিজাত ফু-ওয়াং ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। সঙ্গে ছিলেন ঢাকা জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে ক্লাব ও বারে ক্যাসিনো কিংবা অবৈধ কিছু পায়নি পুলিশ। কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হয় তাদের অভিযান। এর দুদিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর একই ক্লাবে ফের অভিযান চালায় র্যাব। রাতভর অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ অবৈধ মাদক। র্যাবের হিসাব অনুযায়ী, ক্লাবটি থেকে ১০ হাজার ক্যান বিদেশি বিয়ার, দুই হাজার বোতল বিদেশি মদ এবং বিপুল পরিমাণ সিগারেট জব্দ করা হয়। এগুলোর অধিকাংশই অনুমোদনহীন। সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু ব্র্যান্ডের মদ আনার অনুমোদন থাকে। জব্দ করা মদ সেই তালিকায় নেই।
‘পুলিশ পেল না, র্যাব কীভাবে পেল?’ একই প্রশ্ন র্যাবকে করা হলে র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, পুলিশের অভিযানের পর তারা এগুলো ক্লাবে তুলতে পারে।
এদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পর তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নেয় র্যাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, খালেদ ক্যাসিনোর টাকা ভাগ পেত ডিএমপির এমন কয়েকজন সদস্যের নাম বলেছেন।
এদিকে মাঠপ্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তার মতে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হন না। সেক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার (গোয়েন্দা) প্রতিবেদনে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে প্রশাসনের গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এর আগে ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা গোয়েন্দা প্রতিবেদন মুক্ত পদোন্নতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারণ গোয়েন্দা প্রতিবেদন অপপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হয়রানি করার বহু অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কর্মকর্তাদের ওপর দলবাজির তকমা পড়ে। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী এসব অনিয়ম থেকে বের হয়ে এসে একটি স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের কর্মমূল্যায়নে অন্যান্য মাপকাঠির সঙ্গে এর চর্চা আরো বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সকালের সময়কে বলেন, বিষয়গুলো সত্যিই দুঃখজনক, আজকাল প্রশাসনে শিক্ষায় সব জায়গায় একটা নৈতিক স্খলন লক্ষ্য করছি। যা একটা বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ পাচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে এখন রীতিমতো গবেষণা করা দরকার। অপরাধীকে চিহ্নিত করতে হবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাসহ দায়িত্বপ্রাপ্তদের শুদ্ধাচারের ধারণা, প্রশিক্ষণ দিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অপরাধের সংখ্যা জানো বৃদ্ধির না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হবে কর্তৃপক্ষকে কাউন্সিলিং করাতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু সকালের সময়কে বলেন, প্রশাসনকে মনে হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে, একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।
অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল সকালের সময়কে বলেন, পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না, আইনের শাসন নেই। প্রশাসনের যারা আছে তারা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। পুলিশ রেগুলেশন অ্যাক্ট আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুলিশ আইনের বাইরে কিছু করতে পারেনা, কিন্তু শুধু তাদের পদমর্যাদা, স্বার্থরক্ষা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা যেন মূল লক্ষ্য। সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও নীতিবোধের চর্চা নেই রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে তারা। অন্যায়ের প্রতি জোরালো পদক্ষেপ নেই। আইন ছাড়া তারা স্বার্থকে গুরুত্ব দিচ্ছে। অপরাধগুলো দীর্ঘদিন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) আ. গাফ্ফার খান জানান, ডিসি-ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গ্রুপে তদারকি করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নজরদারি করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের ধাপে ধাপে বিভাজন করে দেয়া হচ্ছে। এতে ভালো ফিডব্যাকও পাওয়া যাচ্ছে।