যুবলীগ চেয়ারম্যানের উত্থান, ব্যাংক হিসাব তলব

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র রাজনীতি

কোটিপতি যুবলীগ নেতা পলিথিন জাকির

 

বিশেষ প্রতিবেদক : যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তার নামে থাকা সব হিসাবের লেনদেনের তথ্য, বিবরণীসহ সব পাঠাতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট এ নির্দেশনা দিয়েছে।
ওমর ফারুকের উত্থানের যেন রূপকথার মতো। তামাক দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও একসময় করেন তৈরি পোশাকের ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসায় সাফল্য পাননি তিনি। হয়েছেন ঋণ খেলাপী। তবে যুবলীগের সভাপতি হয়েই ভাগ্য বদলে যায় তার।
ওমর ফারুক ২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিম-লীর সদস্য হন। এর আগের কমিটিতে ছিলেন কার্যনিবার্হী কমিটির সদস্য। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরপর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া ওমর ফারুক চৌধুরী সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিড়ি শ্রমিক লীগের নেতা হয়ে মিয়ানমার থেকে তামাকের বিকল্প টেন্ডু পাতা আমদানি শুরু করেন তিনি। এরপর এরশাদ ক্ষমতায় আশার পর ওমর ফারুক চৌধুরী শ্রমিক লীগের রাজনীতি ছেড়ে যোগ দেন জাতীয় পার্টির যুব সংহতিতে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সদস্য হন তিনি।
১৯৮৮ সালে রাউজানে পোশাক কারখানা স্থাপন করেন তিনি। তবে এই ব্যবসা করতে গিয়ে সম্পদ নিলামে ওঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় ওমর ফারুকের। ১৯৯৭ সালে ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার স্ত্রীর নামে ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নেয়া হয়। যা পরে ৪৪ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঋণের টাকা আদায় না করতে পেরে অর্থ আদায়ে আদালত যায় ব্যাংক।
ওমর ফারুক চৌধুরী জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহামন মঞ্জুর ভায়রা ভাই এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভগ্নিপতি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর দিনই তার বক্তব্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যুবলীগের সম্পৃক্ততা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যে নিজেই পড়ে যান বেকায়দায়।
এদিকে চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এবার যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
ব্যাংক হিসাব তলব : যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সব ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট থেকে ওমর ফারুক চৌধুরীর সব ব্যাংক হিসাব তলব করে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ওমর ফারুক চৌধুরীর নামে থাকা সব ধরনের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন, বিবরণীর তথ্য তিন কার্যদিবসের মধ্যে পাঠাতে হবে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির ঘটনায় এর আগেও কয়েকজন যুবলীগ নেতা ও ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেকের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধও (ফ্রিজ) করা হয়। ফ্রিজ করা হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিম-লীর সদস্য হন ওমর ফারুক। এর আগের কমিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান। সাধারণ সম্পাদক হন হারুন-অর রশিদ। ২০১৬ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হলেও যুবলীগের আর সম্মেলন হয়নি।
সম্প্রতি রাজধানীতে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর তিনি প্রশ্ন তুলেন যে, এতদিন অবৈধভাবে চলা ক্যাসিনো বা জুয়ার বিরুদ্ধে কেন অভিযান চালানো হয়নি? এখানে উল্লেখ্য যে এসব ক্যাসিনোর অধিকাংশ যুবলীগে নেতাদের দখলে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এতদিন অবৈধভাবে ক্যাসিনো চললো কিভাবে? পুলিশ বা র‌্যাব এতদিন কি করেছে? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি তিনি র‌্যাবের অভিযানকে রাজনীতিবিরোধী ষড়যন্ত্র বলেও অভিযোগ করেছেন।
ওমর ফারুকের এমন বক্তব্যের পর তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। এরপরই নিজের অবস্থান বদল করেন তিনি। এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর পিছনে যুবলীগের অনেকে জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে, সংগঠনের সভাপতি হিসেবে এটি তার ব্যর্থতা বলে তিনি মনে করেন।
হকার থেকে কোটিপতি যুবলীগ নেতা পলিথিন জাকির : জাকির হোসেন একসময় মাছ বাজারে পলিথিন ব্যাগ ফেরি করে মাছের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করত। এরপর হঠাৎ করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি বনে যান তিনি। এর পরেই রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকার বনশ্রীতে তার আলিশান বাড়ি, নীলা সুপারসপ নামে বনশ্রীতে বিশাল সুপারসপসহ সোনারগাঁয়ে কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। এমনকি সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি এলাকায় শতবিঘা জমি, ঢাকার আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাটও রয়েছে তার।
জানা যায়, সোনারগাঁ উপজেলার কান্দারগাঁও গ্রামের মোনতাজ উদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন। জীবন নির্বাহের তাগিদে একসময় মাছ বাজারে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি করতো। যার ফলে এলাকায় তাকে ‘পলিথিন জাকির’ নামেই চেনে সবাই। পরে মেঘনা ঘাটে হকারির পাশাপাশি এলাকায় বালু ভরাট ও জমি বিক্রির দালালিও চালিয়ে যান সমান তালে।
একসময় ‘সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি’ নামে একটি আবাসন প্রকল্পের জমি ক্রয় ও বালু ভরাটের দায়িত্ব পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে জাকির। সাধারণ মানুষের জমি দখল, ভুয়া দলিলে জমি বিক্রি এবং বালু ভরাটের টেন্ডারবাজি করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জাকিরের নেতৃত্বে মেঘনা নদীতে চলাচলরত বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদাবাজি, গণপরিবহনে ডাকাতি, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের প্রতিবাদে এলাকাবাসী কয়েকবার মানববন্ধন করলেও কোন প্রতিকার পায়নি।
দুটি হত্যা ও নৌ-চাঁদাবাজিসহ প্রায় ডজনখানেক মামলার আসামি পলিথিন জাকির। ২০১২ সালে রিপন হত্যা, ২০১৪ সাথে সাধন হত্যা ও ২০১৫ সালে গোলজার হত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় জাকির। ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খুন হয় জাকিরের সকল অপকর্মের সাক্ষী ভাগিনা মোহাম্মদ আলী।
এলাকাবাসী জানান, চতুর জাকির তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সাধন এবং ভাগিনা মোহাম্মদ আলীকে হত্যার আগে পরিকল্পিতভাবে অন্যকে ফাঁসিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায়ের জন্য খুন হওয়ার দু-এক দিন আগে সোনারগাঁ থানায় তাদের নিরাপত্তা চেয়ে সে নিজে বাদী হয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরি করার দুই দিন পর সাধন এবং একদিন পর মোহাম্মদ আলীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, জাকির যদি তার কোনো আত্মীয় কিংবা তার ব্লকের নেতার নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন তাহলে স্পষ্ট যে এক সপ্তাহের মধ্যে ওই আত্মীয় কিংবা নেতা নিশ্চিত খুন হবে। তার ভাগিনা মোহাম্মদ আলী হত্যার মামলার ভয় দেখিয়ে সে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলেও জানা যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে মার্চ মাসে সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগ সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন ২টি হত্যা মামলাসহ প্রায় ডজন মামলার আসামি জাকিরকে পিরোজপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হিসেবে নাম ঘোষণা করেন। অভিযোগ ওঠে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জাকিরের কাছে পদ বিক্রি করেন উপজেলা যুবলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু ও সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার।
যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে জাকির। একই বছর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সাথে তার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল করে প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অবৈধ সুবিধা আদায় করেন। জাকির হোসেন বর্তমানে কয়েকশো কোটি টাকার মালিক বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈদ্যের বাজার এলাকার খেয়াঘাট গিয়ে জানা যায়, ‘মেসার্স পিয়াল এন্টারপ্রাইজ’ নামে বৈদ্যের বাজার থেকে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত ইজারা নেন জাকির। অতিরিক্ত চাঁদাবাজির কারণে তার ইজারা বাতিল করা হলে ‘কান্দারগাঁও যুব কল্যাণ সমিতি’র নামে আবারও ইজারা নেন। একই অভিযোগে তা বাতিল হলে পুনরায় ইজারা পায় কান্দারগাঁও গ্রামের একতা সংঘের সভাপতি আমজাদ হোসেন। কিন্তু ইজারার নিয়ন্ত্রণ থাকে জাকিরের হাতেই। ইজারা বাতিল হলেও জোরপূর্বক নৌপথে চাঁদাবাজি করতেই থাকে জাকির। সোনারগাঁ উপজেলায় নৌপথের চাঁদাবাজির একচ্ছত্র অধিপতি জাকির।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নৌযান থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে জাকিরের সন্ত্রাসী বাহিনীর ২০-২৫ জনের একটি দল। যারা তিন থেকে চারটি নৌকার মাধ্যমে এ কাজ করে থাকে। প্রতিটি নৌকায় ৬-৮ জন করে থাকে। তাদের রয়েছে গজারির লাঠি থেকে শুরু করে আধুনিক অস্ত্র।
এ ব্যাপারে জাকিরের সাথে যোগাযোগ করতে কয়েকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। জাকিরের ছোট ভাই আল-আমিন নৌ-চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা ঠিকাদারি করে টাকা রোজগার করছি। মহাখালীতে ‘জাকির রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার কম্পানি লিমিটেড’ নামে আমাদের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *