সম্রাটের গডফাদারদের খোঁজে গোয়েন্দারা
মহসীন আহমেদ স্বপন : অবৈধ ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজিসহ নানা দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ক্যাসিনো সম্রাট খ্যাত যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নেপথ্যে থাকা গডফাদার ও মদদদাতাদের খোঁজে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তে নেমেছে র্যাবের একাধিক টিম।
বুকে ব্যাথা অনুভব করায় মঙ্গলবার সকালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। তবে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের শারীরিক অবস্থা বর্তমানে ভালো আছে। সে আগে থেকেই হার্টের রোগী হওয়ায় তার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছে। সেখানে তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আফজালুর রহমান। তিনি বলেন, সকালে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি সিসিইউতে নং ৩ এ ভর্তি আছেন।
আফজালুর রহমান জানান, ১৯৯৮ সালের সম্রাটের হার্টের একটি ভাল্ব রিপ্লেস করা হয়েছে। বর্তমানে তার সেই ভাল্ব ভালোভাবেই কাজ করছে। তিনি আরও জানান, সম্রাটের চিকিৎসায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি জরুরি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তাদের অধীনে তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে আসলে পরবর্তী অবস্থা জানা যাবে বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক। সম্রাটের চিকিৎসার বিষয়ে কোনো ঘাটতি হবে না বলে জানান তিনি।
সম্রাট যে ডাক্তারের অধীনে ভর্তি রয়েছেন, তিনি পরবর্তীতে সম্রাটের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক।
কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে গত সোমবার প্রথম দিন বিমর্ষ অবস্থায় কাটিয়েছেন সম্রাট। তবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি খাবার ও ওষুধ খেয়েছেন। অন্যদিকে সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করেছে র্যাব। এর মধ্যে মাদক মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকেও আসামি করা হয়েছে। গত সোমবার বিকেল ৪টার দিকে র্যাব-১ বাদী হয়ে রমনা মডেল থানায় মামলা দু’টি করে। দুই মামলার বাদী হয়েছেন র্যাব-১ এর ডিএডি আব্দুল খালেক।
রমনা থানায় দুটি মামলার মধ্যে একটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে, অন্যটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় শুধু সম্রাটকে আসামি করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সম্রাটের সঙ্গে আরমানকেও আসামি করা হয়। অস্ত্র মামলায় সম্রাটকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ।
এছাড়া অস্ত্র আইনের মামলায় টেন্ডার কিং নামে পরিচিত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের জামিন নামঞ্জুর করেছে আদালত। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে মানিলন্ডারিং ও মাদক আইনের মামলায় তৃতীয় দফায় ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাসিনো ও অবৈধ টেন্ডারবাজির ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসবে তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, গত ১৮ সেপ্টেম্বর আমরা প্রথম ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযানটি শুরু করেছিলাম। ইতোমধ্যে ২০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত কিছু নাম ও ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। রোববার সম্রাটকে গ্রেফতার করেছি, তার ছয় মাসের জেল হয়েছে। এখন আলোচনা হচ্ছে, তার কে কে গডফাদার, কারা তার মদদদাতা। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্রাটের অবৈধ অর্থের উৎস কোথায়, ক্যাসিনোর টাকা কোথাও না কোথাও একত্রিত হতো। তা কোথাও যেত, দেশের বাইরে অর্থপাচার হতো কি না তা খোঁজা হবে। আমরা খুব অল্প সময় সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাকে পুরোপুরি জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পেলে এসব জানার চেষ্টা করা হবে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে দু’টি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় রিমান্ড চাওয়া হবে। বিদেশে অর্থপাচার মানিলন্ডারিং আইনে অপরাধ। এটা আমাদের অন্যান্য সংস্থা সাধারণত তদন্ত করে। তবে আমাদের কাছে সম্রাটের বিদেশে অর্থপাচারের ব্যাপারে কিছু তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করব। মানিলন্ডারিং নিয়ে র্যাব তথ্যগত সহযোগিতা করবে।
সম্রাটের প্রশ্রয়দাতাদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার পেছনে মূল হোতা বা গডফাদারদের খোঁজা হচ্ছে। যেই হোক না কেন, ক্যাসিনোর সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখনই তা বলার সময় আসেনি। আমরা সম্রাটকে রিমান্ডে চাইব। রিমান্ড পেলে জিজ্ঞাসাবাদ করব। কারা তার মদদদাতা, আশ্রয়দাতা সেটা বের করার চেষ্টা করা হবে।
ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান শুরুর পর সম্রাটের নাম আসার পর থেকেই তাকে নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। অভিযান শুরুর পর হাইপ্রোফাইল কয়েকজন গ্রেফতার হলেও খোঁজ মিলছিল না সম্রাটের। এসবের মধ্যেই তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর শনিবার রাত থেকেই তার গ্রেফতার হওয়ার খবর এলেও রোববার সকালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। রোববার ভোর ৫টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় আত্মগোপনে থাকা সম্রাটকে। তার সঙ্গে আরমানকেও আটক করা হয়। পরে ঢাকায় এনে তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করে র্যাব। রোববার ৬ অক্টোবর দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল সম্রাটকে নিয়ে কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে তালা ভেঙে তারই কার্যালয়ে ঢুকে অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত অভিযান চলে। সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয় থেকে একটি পিস্তল, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা ও দু’টি ক্যাঙ্গারুর চামড়া জব্দ করে তারা। পরে ছয় মাসের জেল দিয়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রোববার গ্রেফতারের পর ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
র্যাব আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ভয়ংকর সন্ত্রাসী। তিনি ঢাকার মতিঝিলের ইয়ংমেনস ক্লাব, আরামবাগ ক্লাবসহ ফকিরাপুলের অনেক ক্লাবে ক্যাসিনোর আসর বসিয়ে রমরমা মাদক ব্যবসাসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন। এসব অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে খালেদ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। এসব ক্লাবে দিনরাত জুয়া খেলা হতো, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত খালেদের হাতেই। এ ছাড়া খালেদ খিলগাঁও-শাহজাহানপুর চলাচলকারী গণপরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। খালেদ কোরবানির ঈদের সময় শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া, কমলাপুর, সবুজবাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় করতেন। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান; বিশেষ করে রাজউক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ফকিরাপুলসহ বেশির ভাগ এলাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করার জন্য গড়ে তোলেন বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। এই সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে রয়েছে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে বলা হয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ পায়, আসামি জি কে শামীম একজন চিহ্নিত চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, অবৈধ মাদক ও জুয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। আর এই আসামির সহযোগীরা (দেহরক্ষীরা) উচ্চ বেতনভোগী, কুকর্মের সহযোগী। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও মূলত তাঁরা অস্ত্রের লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে এসব অস্ত্রশস্ত্র বহন এবং প্রদর্শন করেছেন। এর মাধ্যমে জনমনে ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসাসহ স্থানীয় বাস টার্মিনাল, গরুর হাটে চাঁদাবাজি করেন। প্রতিবেদন দিয়ে আরও বলা হয়, আসামি শামীম অস্ত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাদক ব্যবসা ও মানি লন্ডারিং করে আসছেন।