*সাকিবের পাশে থাকবে মন্ত্রণালয়
*গণমাধ্যমকে সাকিবের পক্ষে থাকার আহ্বান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর
*সাকিবের ভুলের বিষয়টি জানতো বিসিবিও
মহসীন আহমেদ স্বপন : ম্যাচ ফিক্সিং-এর প্রস্তাব পেয়েও তা আইসিসিকে না জানানোয় আইসিসি কর্তৃক ২ বছরের জন্য বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে নিষিদ্ধ করলো আইসিসি। ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করলেও আইসিসি কিংবা বিসিবিকে না জানানোর কারণেই এই শাস্তি আরোপ করা হলো ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
তবে, দোষ স্বীকার করার কারণে, ১ বছরের শাস্তি স্থগিত করেছে আইসিসি। আইসিসির পক্ষ থেকেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেছেন, আইসিসির সিদ্ধান্ত যাই হোক তারা সাকিব আল হাসানের পাশেই থাকবেন।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাকিবের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত যে খবর গণমাধ্যমে আসছে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন বিষয়টি নিয়ে তিনি ক্রিকেট বোর্ডের সাথে তিনি কথা বলেছেন। তারা আশ্বস্ত করেছে যে আজকের মধ্যেই এ বিষয়টি তারা আইসিসির কাছে লিখবে এবং আশা করছি আজই জানা যাবে যে আসলে কি হতে যাচ্ছে।
জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ক্রিকেট বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আইসিসির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সাকিবকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যেখানে এমন কঠিন সময়ে গণমাধ্যম যেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর কোনো খবর না প্রকাশ করে সে আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে সাকিবের ভারত সফর বাতিল করা হয়েছে। বছর দুয়েক আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচ চলাকালীন জুয়াড়ির (বুকি) কাছ থেকে একটি অনৈতিক প্রস্তাব পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। সেই প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সত্যি, কিন্তু নিয়ামানুযায়ী আইসিসিরি দুর্নীতি দমন বিভাগকে তা জানাননি, গোপন রেখেছিলেন। বিষয়টি পরে আইসিসি জানতে পারে এবং আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের কল ট্র্যাক করে এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য উদ্ধার করে। ওই জুয়াড়ি আইসিসির কালো তালিকায় থাকাদের একজন।
বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরে আইসিসি অ্যন্টি করাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিট (আকসু) সাকিবের সঙ্গে কথা বলে। জানা গেছে ওই তদন্ত কর্মকর্থার কাছে সাকিব ভুল স্বীকার করেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি বলেন, ‘জুয়াড়ির প্রস্তাব গুরুত্ব দেইনি বলেই কাউকে জানাইনি।
বিষয়টি হালকাভাবে নিয়েছিলেন লাল-সবুজের এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। যা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। ১৮ মাসের জন্য সবধরণের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। যা নিঃসন্দেহে এদেশের ক্রিকেটের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ।
আইসিসিরি দুর্নিতীদমন নীতিমালায় লেখা আছে, কোনো ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, আম্পায়ার, স্কোরার, গ্রাউন্ডসের সদস্য, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ জুয়াড়িদের কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রস্তাব পেলে তাৎক্ষণিক তা বোর্ডের দুর্নীতি দমন ইউনিটকে জানাতে হবে। যতটা দ্রুত সম্ভব।
সাকিবের ভুলের বিষয়টি জানতো বিসিবিও : অসতর্কতার কারণে এক জুয়াড়ির টেলিফোনের তথ্য গোপনের মাশুল গুনতে যাচ্ছেন টাইগারদের টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের। আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের কোড অব কন্ডাক্ট বলছে এ জন্য অভিযুক্তের সাজা হতে পারে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। আর অপরাধ লঘু হলে সর্বনি¤œ ছয় মাস। এছাড়াও সাজার বিরুদ্ধে সুযোগ আছে আপিল করার।
ছোট্ট একটা ভুলের সবচেয়ে বড় মাশুল গুনতে হচ্ছে সাকিব আল হাসানকে। নিষিদ্ধ বুকির কাছ থেকে দুই বছর আগে পেয়েছিলেন ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব। সেটা প্রত্যাখ্যান করলেও সাকিব তা অবহিত করেননি বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি ও বিসিবিকে! আর তাতেই সর্বনাশ কয়েক বছর ধরে অবস্থান ধরে রাখা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের!
আইসিসির কোড অব কন্ডাক্টে দুই এর চার দশমিক চারের উপধারায় ব্যাখ্যা আছে বিষয়টির। সেখানে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়, এমন কোনো প্রস্তাব পেলে সরাসরি দারস্থ হতে হবে আইসিসির। তখন তদন্ত সাপেক্ষে বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ্ব ক্রিকেটের অ্যান্টি করাপশন ইউনিট।
বিভিন্ন সূত্রের খবর নিজের ভুলের বিষয়টি সাকিব অবগত প্রায় এক বছর আগে। যেটা জানে বিসিবিও। কিন্তু হয়েছে বড্ড দেরি। তাই নিষেধাজ্ঞা ছাড়া খোলা নেই অন্য কোনো পথ। চোখ রাখা যাক আবারও কোড অব কন্ডাক্টে। কী বলেছে সেখানে আইসিসি?
এমন কাজের সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ হতে পারে পাঁচ বছর। যেখানে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কোনো কাজেই অংশ নিতে পারবেন না অভিযুক্ত। পাপ লঘু হলে নিষেধাজ্ঞা অন্তত ছয় মাসের। তাই সাকিবের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে বিষয়টা স্পষ্ট নয় এখনই।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, আগেও এমন শাস্তির নজির আছে বিশ্ব ক্রিকেটে। ২০১৪ বিপিএল চলাকালীন বুকির কাছ থেকে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েছিলেন শীলঙ্কান ক্রিকেটার কৌশল লোকুয়ারচ্চি। তথ্য গোপন করায় তাকে ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আইসিসি।
শেষ পর্যন্ত সাকিবের ভাগ্যে কী ঘটবে তার জবাব মিলবে শিগগিরই। তবে যে নিষেধাজ্ঞাই আসুক আপিল করতে পারবেন বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার। এবার শুধু অপেক্ষার পালা।
বড় ধরনের চক্রান্তের আভাস : সোমবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ক্রিকেট পাড়া সরব ছিল সাকিবকে নিয়ে। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন ছিল, সাকিব কি আদৌ ভারত সফরে যাবেন? নাকি গ্রামীণফোনের সঙ্গে করা চুক্তির কারণে বোর্ডের কাছ থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়ে ক্ষুব্ধ সাকিব ভারত সফরে না যাওয়ার পাঁয়তারা করছেন?
বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মুখেও এমন কথা উচ্চারিত হয়েছে যে, সাকিবসহ কয়েকজন ভারত সফরে না যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। আর সে কারণেই সাকিব ইস্যুতে বোর্ড সভাপতি সোমবার বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বোর্ডে কাটিয়েছেন। বোর্ড পরিচালক, কোচিং স্টাফ ও ক’জন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছেন।
তখন শোনা যাচ্ছিল, সাকিব ভারত সফরে যেতে চাচ্ছেন না। তাকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। আর সাকিব শেষ পর্যন্ত না গেলে সম্ভাব্য করণীয় কী হবে? তা নিয়েই নাকি সব কথাবার্তা হয়েছে।
কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গেই সঙ্গেই হাওয়া পাল্টাতে আরম্ভ করলো। রাতে বোর্ডের ক’জন পরিচালকের কথায় কেমন যেন ভাব! রাত ১২টা গড়িয়ে মঙ্গলবার প্রথম প্রহর থেকেই কানাঘুষা, আরে সাকিব ভারত সফরে যাবেন কি যাবে না- সেটা বড় নয়। সাকিব আদৌ যেতে পারবেন কি না সেটাই দেখার।
বোর্ডের অন্তত দু’জন পরিচালকের মুখে এমন কথা শোনার পরও ঠিক বোঝা যায়নি আসল ঘটনা কী? পরে মধ্যরাতে (সোমবার দিবাগত রাত দুইটায়) দিকে জানা গেল খবর, যা শুনে শুধু সাকিব সমর্থকরাই মুষড়ে পড়বেন না, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভক্ত ও সমর্থক যে কারো মাথায়ই বাজ পড়ার উপক্রম হবে।
বোর্ডের দায়িত্বশীল সূত্রের খবর, সাকিব আসলে ভারতে যেতে চাচ্ছেন না খবরটি ঠিক নয়। আসলে তিনি যেতে পারবেন না। সম্ভবত আইসিসির দুর্নীতি দমন সংস্থার রায়ে ১৮ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন সাকিব। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিশাল-বাজিকরদের কাছ থেকে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও নিশ্চুপ থাকা।
আইসিসির কোড অব কন্ডাক্টে বলা আছে, বাজিকরদের কাছ থেকে ম্যাচ বা স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট বোর্ডকে জানাতে হবে। না হয় আইসিসির দুর্নীতি দমন সংস্থা- আকসুকে অবহিত করতে হবে। সে খবর নিজে লুকিয়ে রাখলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সাকিব তার কোনোটাই করেননি।
এ বিষয়ে বোর্ড কর্তারা সোমবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চরম গোপনীয়তা ও নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খবর এদিক-ওদিক থেকে চাউর হতে থাকে।
এ ছাড়া সাকিবের বিপক্ষে আরও একটি অভিযোগ উঠেছে। তা হলো বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপনকে সরানোর নকশা আঁটা। বর্তমান বোর্ড ভাঙ্গার চেষ্টার অভিযোগও নাকি আছে সাকিবের বিরুদ্ধে। অবশ্য এই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সংশয় আছে।
যদিও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ক্রিকেটারদের আন্দোলনের শুরু থেকেই বলে আসছেন, বড় ধরনের চক্রান্ত হয়েছে। সেই চক্রান্তর জাল ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। সব মিলে চ্যাম্পিয়ন অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের বিপক্ষে গুরুতর অভিযোগ সামনে উপস্থিত। অভিযোগের তীরে বিদ্ধ সাকিব শেষ পর্যন্ত কীভাবে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, সেটাই দেখার।