সুলেখা আক্তার শান্তা
বারোটা বাজে সাজেদা রান্না ঘরে ঢুকলো। তাকাতেই দেখতে পেল কলসিটি খালি। এরপর খালি কলসি নিয়ে রওনা দিল পুকুর ঘাটে। ঘাটের কাছে আসতেই দেখতে পেল অনেকগুলো আম পড়ে আছে পুকুর পাড়ের আম গাছের নিচে আর কিছু পুকুরের পানিতে পড়ে ভাসছে। অবাক হয়ে সাজেদা। ভাবলো এতগুলো আম পড়ল কি করে! ঝড়-তুফান কিছুই না, কাউকে দেখছিও না আম পাড়তে। অথচ এতগুলো আম পড়ে আছে। থাক না ভেবে তার চেয়ে আমগুলো কুড়িয়ে নেই আচার দেওয়া যাবে। তারি মাঝে কানের কাছে আওয়াজ এলো এই যে আমগুলো নিবেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ও আমাকে তো খুঁজছো? আমি এইতো। উপরের দিকে তাকাতেই একটি ছেলে আম হাতে নিয়ে গাছে বসে আছে। আপনি আম গাছে কেন? মাকে ডাকব।
আমার হাতে আম দেখছ এগুলো আমার আর নিচে আম পড়ে আছে ওগুলো তোমার। তাহলে বলবে কেন? ভাগাভাগি তো হয়েই গেল।
সাজেদা বলে, গাছ আমাদের আরা আম ভাগাভাগি করছেন আপনি? আপনার সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি পানি নিতে এসেছি পানি নিয়ে চলে যাই। কলসিটি পানিতে এদিক-ওদিক ঢেউ দিয়ে পানি ভরে বাড়ির দিকে রওনা হলো। এমন সময় ছেলেটি বলল, তোমাকে না আমার ভালো লাগে। সাজেদা একটু লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকালো। ছেলেটি বলল, তুমি আমাকে তো চেনো? নাকি চেনো না?
সাজেদা বলে, চিনবো না কেন? আপনি সাজেদ ভাই।
সাজেদ বলল, আমি কিন্তু ঘাটে আইসা তোমার দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকি। তুমি যখন আসতে তোমার হাতের চুড়ির শব্দে আমি বুঝতাম যে তুমি আসছো।
সামনে না এসে, আড়ালে থাকেন কেন?
আড়াল থেকে তোমাকে দেখি।
দেইখা মনটা ভইরা যাইতো বুঝি?
সাজেদ নিজের মাথার চুল ধরে, হ্যাঁ যাইতো।
যাই রান্না করতে হবে।
কাল এমন সময় আসবা?
সাজেদা মাথা নেড়ে, হ্যাঁ বলল।
কাল এমন সময় আমি পুকুরঘাটে থাকব।
তারপরের দিন কতক্ষণে আসবে ঘাটে সাজেদ ভাবে কাউকে ভালো লাগলে ভালো লাগার মানুষটি চোখের সামনে থেকে সরে না। মনে পড়ে তার কথা বারে বারে। দুজন একই সময় পুকুর ঘাটে এলো। তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। এভাবেই তাদের দেখা হতে থাকে কিছুদিন।
এরপরে তাদের বিয়ে হয়। খুব ভালো ভাবেই কাটতে থাকে তাদের দিন। একদিন একজন আরেক জনকে বলল, আমাদের এই দুজনার ছোট সংসার আমরা অনেক সুন্দরভাবে সাজাবো। সেখানে থাকবে শুধু সুখ আর সুখ। সাজেদা বলে, শোনো আমরা দুজনে ঢাকা যাব চাকরি করব।
সাজেদ বলে, আমাদের তো সেরকম শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। ঢাকায় যেয়ে আমরা করব কি?
সাজেদা বলল, আমরা দুজনে গার্মেন্টসে চাকরি করব। অনেক ভালোভাবেই আমরা থাকতে পারব।
অবশেষে তারা দুজন স্বপ্নপূরণের উদ্দেশে ঢাকায় আসে। চাকরি ও বেতনের আশায় থাকতে হবে। তার পূর্বে সংসারের তো খরচ আছে। বাড়ি থেকে আসার সময় কিছু খরচপাতি নিয়ে আসে। এই টাকা দিয়ে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাকি দিনগুলো চলতে হবে।
তারা দুজনেই গার্মেন্টস চাকরি পেয়ে যায়। সারাদিন অফিসে করে যখন তারা বাসায় ফিরে, দুজন দুজনকে দেখে সব পরিশ্রমের সব কষ্ট কথা ভুলে যায়।
বেশ কিছুদিন পর সাজেদার গর্ভে সন্তান আসে। খুশিতে মেতে ওঠে তারা দুজনেই। সাজেদ তার স্ত্রীকে চাকরি করতে দেন না। সাজেদা এরপর বাসায় থাকে, তাদের স্বপ্নের সন্তান পৃথিবীতে আসবে। ভাবে স্বপ্ন মানুষকে বাঁচাতে শিখায়। তারপর দিন যায় সাজেদার সন্তান পৃথিবীতে আসার দিন ঘনিয়ে আসে। কিছুদিন পর কোল জুড়ে ফুটফুটে ছেলে সন্তান আসে। স্বামী আর স্ত্রী দুজনে মিলে সন্তানের নাম রাখে চাঁদ। তারা দুজনেই ভাবে চাঁদ যেমন রাতের আলোতে ঝলমলিয়ে আলো দেয়। তেমনি আমাদের চাঁদও ঝলমলিয়ে আলো দেয়। তাদের এই ছোট্ট সুখের সংসার ভালোই যাচ্ছিল দিন। তাদের তৃপ্তির আনন্দে কাটে দিন।
একদিন সাজেদ অফিস থেকে এসে শুয়ে পড়লো। সাজেদার সঙ্গে কোন কথাই বলছে না। সাজেদা জিজ্ঞাস করল কি ব্যাপার তুমি এসে শুয়ে পড়ছো? শরীর খারাপ নাকি? তাও কথা বলছে না। এরপরে ভাত বেড়ে দিয়ে খেতে বলল, তাও খেলো না। সাজেদা ছেলেকে খাইয়ে নিজে না খেয়ে শুয়ে পড়ল।
সকালে উঠে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে স্বামীকে ডাকলো অফিসে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো উত্তর পেল না। সাজেদ ঘুম থেকে ওঠে না খেয়ে বাসা থেকে বের হয়। সাজেদের এই ব্যাপারে সাজেদার মন ভীষণ খারাপ হয়। স্বামী খাওয়া-দাওয়া করছে না, তার কাছ থেকে, কি হয়েছে তার কোনো কিছু জানতেও পারছে না। থাক বাসায় এলে জানবো। অপেক্ষা করল সাজেদর জন্য, কিন্তু সে লাঞ্চের সময়ও বাসায় এলো না। সাজেদা ভাবনায় পড়ে গেল। পরে নিজেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়। থাক রাতে তো বাসায় আসবে, তখন জানা যাবে কারণটা কি? রাতেও সাজেদ বাসায় আসে না, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বাড়িওয়ালী মিলির কাছে যায় তাকে বলল, আপা চাঁদের বাবা তো বাসায় আসছে না, কি যে করি, তাও বুঝতে পারছি না।
আসেনি আসবে।
আপা চাঁদের বাবা লাঞ্চের সময়ও আসেনি।
ও সময় তো রাত বারোটা, কেন আসছে না, ভাবনার বিষয়।
চিন্তায় সাজেদার রাতে ঘুম এলো না, রাত চলে গিয়ে ভোর হলো। সাজেদা রওনা হলো সাজেদের অফিসে খোঁজ নেওয়ার জন্য। অফিস থেকেও কোনো সন্ধান দিতে পারেনি সাজেদের। হঠাৎ সাজেদের এরকম নিখোঁজ হওয়ার কারণ খুঁজে পেল না। পরিচিত সবার কাছেই জিজ্ঞেস করল। কেউ কোন কিছুই বলতে পারে না। সাজেদকে না পেয়ে সাজেদা একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।
এভাবেই চলে যায় সাজেদের খোঁজ না পাওয়ার অনেক দিন। সাজেদা অপেক্ষায় থাকে স্বামী ফিরে আসবে। ঘরে যে খোরাক ছিল তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। চিন্তায় পড়ে যায়। এ বেলা খেয়ে থাকলে তো ও বেলা না খেয়ে থাকে। ভাবে যেটুকু চাল আছে যদি শেষ হয়ে যায়। স্বামী ফিরে না আসা পর্যন্ত বাকি দিনগুলো কিভাবে চলবে, হতাশ হয়ে পড়ে সে। মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে চাকরি ও তো করা যাবে না।
বাড়িওয়ালী মিলি সাজেদাকে বলে, কয়েক মাস তো চলে গেল। তোমার স্বামী তো ফিরে এলো না, আর ফিরে আসবে কিনা তাও তো তুমি জানো না। তুমি এখন কি করবা? আমার বাসা ভাড়াও তুমি দিতে পারছ না। আমার বাসাটা ছেড়ে দাও।
সাজেদা কেঁদে দিল ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব। আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
মিলি বলে, তোমার জায়গা নেই তো আমি কি করব।
আপা বাচ্চাকে নিয়ে এই আমি চাকরি করব আমার এই ঋণ শোধ করব। এখান থেকে আমি যাব না আমার স্বামী যদি ফিরে আসে, আমাকে যদি খুঁজে না পায়। এরপর সাজেদা চাকরি করা শুরু করল। প্রতি মাসে মাসে বেতন পেয়ে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করে। এদিকে চাঁদও আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে থাকে। চাঁদ এখন বড় হওয়ায় দুষ্টামিটা একটু বেড়ে যায়। সাজেদা বলে, ছেলে আমার সাথে অফিসে গেলে এটা ধরে তো ওইটা ধরে ভীষণ দুষ্টুমি করে। ছেলেকে আমার বাসায় রেখে যাব। কয়েকদিন খারাপ লাগবে পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। চাঁদকে বলে, বাবা তুমি বাসায় থাকবে। আমি অফিসে যাব। চাঁদ থাকতে রাজি হয় না। বুঝিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা দেওয়া হলে, এরপর বাসায় থাকতে রাজি হয়।
চাঁদ বেড়ে ওঠায় এদিক ওদিক যেতে পারে। কিছু খেলার সাথী হয়েছে তার। মা অফিসে থাকা কালে তখন সাথীদের সাথে খেলে। বেশ আনন্দে কাটে তার সময়। কিন্তু তারপরও মায়ের কথা তার মনে পড়ে। চাঁদ ভাবে সবার মা তাদের কাছে থাকে আমার মা কেন দূরে থাকে। কেন মা আমায় রেখে কাজে যায়। ছোট মানুষ তাই কাউকে মনের কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না। মা আমি তো তোমাকে সব সময় কাছে চাই। চাঁদ মাকে কাছে পেয়ে বলে, মা সবার মা তো তাদের সন্তানের কাছে থাকে, তাহলে তুমি কেন আমায় রেখে দূরে যাও? সাজেদা ছেলের কথা কোন কিছু না বলে, অবাক দৃষ্টিতে ছেলে দিকে তাকায়। ছেলেকে বুকে টেনে নেয়।
সাজেদা অফিস যাচ্ছে, যাওয়ার সময় দেখলো ছোট ছোট বাচ্চারা হইচই করে করে খেলছে। বাচ্চারা কেউ কেউ চকলেট, আইসক্রিম খাচ্ছে। তা দেখে নিজের ছেলের কথা ভাবে, আমার খোকার যদি এরকম খেতে ইচ্ছা করে। এরপরে সাজেদা ছেলেকে নিয়ে দোকানে যায়। দোকানের নিজামকে বলল, ভাই আমার ছেলে আসলে যখন যা চায় তাই দিবেন। আমি পরে টাকা পরিশোধ করে দিব।
নিজাম বলে, ঠিক আছে দিব আপা।
সাজেদা তারপর কিছু চকলেট ছেলেকে দিল। চাঁদ চকলেট খেতে খেতে বাসায় এলো। আর সাজেদা কাজে চলে যায়।
চাঁদ খেলার সাথীদেরও চকলেট দিল। চকলেট শেষ হলে, তার আবার চকলেট খেতে ইচ্ছে করে। সে চকলেটের উদ্দেশ্যে বন্ধুদের নিয়ে দোকানে যায়। কপালে যদি খারাপ থাকে কে বা তা ঠেকায়।
রাস্তায় ছিল ম্যানহোল ভাঙা। চাঁদ খুশি মনে পথ চলায় কোন দিকে তাকাচ্ছিলো না। চাঁদ হঠাৎ করে পড়ে গেল ভাঙা ম্যানহোলের ভিতরে। চাঁদ চিৎকার করতে থাকে। চাঁদের চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে আসে। এদিকে চাঁদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বেকায়দায় ম্যানহোলের ভিতরে পড়েছে কেউ চাঁদকে তুলতে পারছে না। সবাই ব্যস্ত ছিল ম্যানহোল ভেঙে বের করার জন্য। এরপর ফায়ার সার্ভিস এসে চাঁদকে উদ্ধার করে। সাজেদা ছেলের কথা জানতে পেরে ছুটে চলে আসে। সাজেদা বুকফাটা আর্তনাদ করে, ছেলের জন্য পারে না তো ম্যানহোলে ভিতরে নিজেই ঢুকে পড়ে। সবাই তাকে ধরে থামায়। এদিকে ম্যানহোলের ভিতরে এমনভাবে আটকে গিয়েছিল যে চাঁদকে হাত-পা কেটে বের করতে হয়। চাঁদকে অক্ষত অবস্থায় কিছুতেই বের করা সম্ভব হয়নি। ঘটে গেল চাঁদের জীবনে মর্মান্তিক এক ঘটনা। সাজেদা জানে না তার ছেলের এক হাত-পা চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হলো। চাঁদের এরকম অবস্থা দেখে, সাজেদাকে যেতে দেওয়া হয় না চাঁদের কাছে। মা তার সন্তানকে এমন অবস্থায় দেখে সহ্য করতে না পারে। এদিকে অস্থির হয়ে আছে সাজেদার মন ছেলেকে দেখার জন্য, কোন বাধা মানছে না। কেউ বলছে, মা তার ছেলেকে দেখবে দেখুক, দুদিন পর তো দেখবেই। বারবার কষ্ট পাওয়ার কি দরকার। তার চেয়ে দেখ একদিনই কষ্ট পাক। কেউ বলছে না দেখেই ভালো, বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। মা যখন ছেলেকে দেখতে চাচ্ছে তখন দেখুক। সাজেদা তার ছেলের কাছে যায়। চাঁদর দিয়ে ঢাকা ছিল চাঁদের শরীর, সাজেদা চাদর সরিয়ে দেখলো। ছেলে তার এক হাত-পা চিরদিনের জন্য হারালো। হৃদয় বিদারী কান্নার চিৎকারে ভারী হয়ে উঠলো চারিদিক, একমাত্র অবলম্বন আমার এই ছেলে, আমার বুকের ধন। গরিবের সম্বল থাকে মানুষ আকৃতি দেহ কাজ করে খাওয়ার জন্য। তাই যদি থাকে ক্ষত তখন সে বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে। মা ছেলে দুজনকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। চাঁদ ছিল অচেতন অবস্থয় থাকে ডাক্তার দেখানোর পর জ্ঞান ফিরে আসে। সাজেদা ছেলের পাশে বসে ভাবে। আঘাত খাওয়া মানুষের আঘাতই হয় তো তার ভাগ্যের লিখন। এই আঘাত এর যন্ত্রণা তো ভোগ করতেই হবে। চাঁদ একটু সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসে। ছেলেকে দেখে অঝোরে কেঁদে কেঁদে দিন যায়। কি করবে কিছুই ভেবে পায় না। অন্তত দুমুঠো খাবারের জোগার করতে হবে। ছেলেকে বাসায় রেখে অফিসে যেতে হবে। এই অবস্থায় ছেলেকে আমার সাথে নিয়েও তো যাওয়া যাবে না। ছেলে আমার কিভাবে থাকবে একা বাসায়। ভেবে কোন সমাধানই পায় না সাজেদা।
বড় আশা করে সাজেদা অফিসে আসে। অফিস থেকে জানলো তার চাকরি নেই। অসহায় ভাবে কেঁদে সে, আমি এখন ছেলেকে নিয়ে কি করব।
অফিস থেকে বলা হল, তোমার ছেলের এরকম দুর্ঘটনা হয়েছিল সে কথা আমাদের তো জানাতে পারতে?
আমার ছেলের দুর্ঘটনায় তখন কি আমার মানসিক অবস্থা ঠিক ছিল, যে আমি জানাবো?
ঠিক আছে দেখি তোমার জন্য কি করা যায়।
সাজেদা বুঝে নিল বৃথা সান্ত্বনা, থাক আমার জন্য কিছুই করতে হবে না, এরপর অফিস থেকে অভিমানে করে চলে বের হয় সাজেদা।
সাজেদার চারিদিকে নিরাশার অন্ধকার। সাজেদা বাঁচার তাগিদে কিছু টাকা লোন করে, তা দিয়ে কিছু কাপড় কিনে ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে বসে। ধীরে ধীরে তা থেকে মোটামুটি ভালই উপার্জন হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাক মা-ছেলে তো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারবো। তাতেই আমার চলবে।
সাজেদার ছেলেকে নিয়ে হতাশার কমে না। তার ছেলে হেসে খেলে আর দশটা ছেলের মতন বেড়াতে পারে না। ছেলের ওষুধ শেষ, আনতে হবে। মার্কেটে যাবে যাবার সময় সাজেদা ছেলেকে বলল, বাবা তুমি থাকো, আমি তোমার জন্য ওষুধ আর জামা কাপড় কিনে আনবো। ছেলের কপালে একটি চুমু দিয়ে বের হলো সাজেদা।
মার্কেট থেকে কেনাকাটা পরে সাজেদা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রোড পার হবে এমন সময় সাজেদা তার স্বামীকে দেখতে পেল একটি মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে। সাজেদা তার স্বামীকে দেখেই সাজেদ সাজেদ বলে, প্রানপনে ডাকলো। কিন্তু সেই ডাকের আওয়াজ তার স্বামীর কানের কাছে পৌঁছে না। এমন সময় সাজেদা একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় রাস্তায়। সাজেদা যন্ত্রণা ছটফট করতে থাকে। কেউ তাকে ধরে না। আস্তে আস্তে লোকজনের সমাগম বাড়তে থাকে। কেউ মোবাইলে ছবি তোলে। কেউ বা পরিচয় জানতে চায়। এত শোরগোলের মাঝে কিন্তু কেউ তাকে কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে না। সবাই ছবি তোলা নিয়েই ব্যস্ত, কে কার আগে ছবি তুলে ফেসবুকে দিবে। সে ব্যাপারে তাদের মনোযোগ। চোখের সামনে একটা মানুষ ব্যথার যন্ত্রণা ছটফট করছে, সেই মানুষটির জন্য তাদের হৃদয়ে সহানুভূতি যাকছে না। তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা পেলে তার জীবন রক্ষা হতো কিনা তা আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। এরপরে সাজেদা সেখানেই চিরদিনের জন্য পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ঠিকানা না জানায়, কারো পক্ষেই তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলো না। এরপর পুলিশ এসে লাশ নিয়ে থানায় যায়। পুলিশও তার কোন ঠিকানার সন্ধান পেল না। সন্ধান না পেয়ে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাকে দাফন করা হয়। চাঁদ অপেক্ষায় থাকে মা আসবে। কিন্তু অপেক্ষা পরেও তার মা আসে না। সে জানে কোথায় আছে তার মা। সে ফিরে আসবে কি আসবে না। চাঁদ ক্ষুধার যন্ত্রণা কাঁদে। এভাবে কি যাবে শিশু চাঁদের দিন, কেইবা নিবে দায়িত্ব। অসহায় শিশু চাঁদের প্রতি কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে কিনা জানি না। নাকি অবহেলায়, অযত্নে, অনাহারে সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, নাকি প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবে।