নিয়তির কাছে অসহায়

সাহিত্য

সুলেখা আক্তার শান্তা

 

আমার বাহারকে বিয়ে করাবো, ওর জন্য লাল টুকটুকে একটা বউ আনবো। বউ আমার সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবে। সবাই দেখবে বলবে ওই দেখো বাহারে বউ দেখতে ভারী সুন্দর। বুঝলে জাহানারা?
জাহানারা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলি, বুঝলাম আপা, তুমি বাহারকে নিয়ে কত কষ্টই না করে বড় করছো, আমরা সকলেই দেখেছি আপা। শাকসবজি চাষ করে তা বিক্রিয় যে টাকা পাইছো তা দিয়েই তো মা ছেলে সংসার চলত। আমরা তো চোখের সামনেই সব দেখেছি।
জাহানারা এখন আমি ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ওর হাতে সংসার বুঝিয়ে দিতে চাই। ভালো ভালাই একটা মেয়ে পেলেই হয়।
আপা তুমি তোমার ছেলের জন্য ভালো একটা বউ পাবা দেখো এই আমি বললাম।
আশা বলে, তাই যেন হয় জাহানারা, তুমি বাহারের বিয়ের ব্যাপারে ঘটকের সাথে কথা বলো।
জাহানারা বলে, উত্তরপাড়ার মনসুর ঘটকের সাথে কথা বলে, তাকে আমি তোমার কাছে নিয়ে আসবো আপা।


বিজ্ঞাপন

জাহানারা দুইদিন পরে ঘটক কে নিয়ে হাজির। বাহারকে দেখে ঘটক বলল, আপা আপনার ছেলে তো কালো, বউ এনে দিব আলো। যাতে রাতে বাতি না লাগে। জাহানারা বলে, আপা আপনি যেমন লাল টুকটুকে বউয়ের কথা বলছেন। আমি তেমনই বউ এনে দেওয়ার কথা বলেছি। আশা বলে, জাহানারা আমার ভরসা এই একমাত্র ছেলে। তাই তো আমি ঘটক ভাইকে বলেছি আপা, ছেলের জন্য একটা পরীর মত বউ এনে দিবে। আপা তাহলে এখন উঠি। বাহার সহজ সরল ছেলে অতশত প্যাঁচ গোজ বোঝে না। গ্রামে যে যাই বলুক মুখে তার হাসি লেগেই থাকে। আর ভালো মন্দ কথা কিছুই বলে না। বাহারের সাথে কখনো কারো বিরোধ হয় না। বাহার শুধু বুঝে কাজ আর কাজ, কাজ না করলে তো ভাত পাওয়া যায় না, এজন্যই তো মা আর ছেলে খেয়ে পড়ে ভালোই আছে।

এরপর ঘটক মেয়ে দেখে বাহারের জন্য বিয়ে ঠিক করে। মেয়েটির নাম পরী। দেখতেও পরীর মত, পরীর সাথে বিয়ে হওয়ার পর পাড়া-প্রতিবেশী সবাই আসে বাহারের বউ দেখতে। বউ কে দেখে মন জুড়িয়ে যায় সবার। পাড়া-প্রতিবেশী আশাকে বলে, যেমনটি চেয়েছিলা তেমনি বউ পাইছো। আশা হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে মনের মত বউ পেয়েছি। বউ শাশুড়ি কেউ কাউকে কাজ করতে দিবে না। এই নিয়ে বউ শাশুড়ির মিষ্টি ঝগড়া হয় দুজনের মধ্যে। অবসরে একজন আরেকজনের মাথায় বিলি দেবে। বাহার বৌকে বলে, নেও তোমার তো আবার আমার জন্য সময় নেই। তোমার আবার সময় কিসের? দেখো না আমরা বউ শাশুড়ি ব্যস্ত। আমরা বেশ ভালো আছি। তার মধ্যে তুমি জ্বালাতন কোরো না। বিকেল বেলা হলে বউ শাশুড়ি পিঠা বানাবে আর পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বউয়ের বানানো পিঠা খেতে আসে।
আশা বলে, তোমরা প্রতিদিনই আসবা আমার বৌমার হাতের পিঠা খেয়ে যাবা। পরী তার মাঝে বলে ওঠে, মা আমি আবার কি করলাম, সব করেন আপনি। শোনো শোনো আমার বউ মা বলে কি? প্রতিবেশী সবাই বলে, তোমাদের বউ শাশুড়ির কথা শুনে আমাদের হাসি পায়।

সুখেই কাটছিল দিন। তার কিছুদিন পরে পরীর পেটে বাচ্চা আসে। আশা জেনে খুব খুশি হয়। আর পাড়া-প্রতিবেশীকে মিষ্টি বিতরণ করে। মনে মনে ভাবে বউয়ের ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। মেয়ে হলে নাম রাখব বর্ষা আর ছেলে হলে নাম রাখব আষাঢ়। বাহার মাকে বলে, তোমার নাতি-নাতনি পৃথিবীতে আসার আগেই তুমি মহা খুশি। মা তোমার খুশিতে আমিও খুশি। শোন বাবা আমার নাতি-নাতনি আসবে পৃথিবীতে আমাকে দাদি দাদি বলে ডাকবে। আমার মনে হয় এখনই আমাকে দাদি দাদি বলে ডাকছে। বৌমাকে ঠিক টাইম মতো গোসল করানো খাওয়ানো তার যতœনেওয়ার শাশুড়ি আশা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সীমিত সামর্থ্য মধ্যে কোন কিছুতেই কমতি রাখতে চায় না।
পরী বলে, মা আমার সবকিছু ঠিক আছে, আমার মনে হয় এবার আপনার দিকে খেয়াল রাখা উচিত। আমি ঠিক আছি বৌমা আমার নাতি-নাতনি আসছে, কি যে আমার ভালো লাগছে। মা যে কি কান্ড করেন না।

বাহার ক্ষেতের কাজ সেরে এসে মা ডাকছে। আশা কিরে বাবা এমন ডাকছিস কেন? জানো মা আমার ক্ষেতের ধান বেশ ভালো হয়েছে। আশা বলে, বৌমা আমার লক্ষী যেখানে যাই করি না কেন তাই বেশ ভালো হয়। আশা তাড়া দেয় বাবা তুই গোসল করে আয় আমি তোকে খেতে দেই। গোসল করে এসে বাহার খাবার খেতে বসলো। তারপর মুখে ভাত দিতেই। পরি বলে উঠলো, মা আমার কেমন যেন লাগছে। অবস্থা দেখে আশা কিছুটা অনুমান করতে পারে। পরীকে তার রুমে নিয়ে যায়। তারপর বাহারকে বলল, যাতো বাবা এখনই তোর দাই খালাকে ডেকে নিয়ে আয়। বাহার তা শুনে মনে মনে খুব খুশি। তারপর তাকে ডেকে আনে। তার কিছুক্ষণ পর বাচ্চা ছেলের কান্নার শব্দ শুনতে পেল। বাহার খুশি হয়ে, মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যায়। ছেলে হওয়ার সুসংবাদটি দেয়। খবরটি শুনে ইমাম সাহেব আযান দেন। নাতি হওয়ার পর খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ে আশা। কিভাবে তার বৌমার আর নাতি ভালো থাকবে সেই দিকে শুধু খেয়াল রাখেন। নাতির নাম রাখেন আষাঢ়।

দিনে দিনে বড় হওয়ায় হাঁটতে শিখেছে আষাঢ়। দাদির হাত ধরে এ পুরো বাড়ি হেঁটে বেড়ায়। আর যাই দেখুক দাদীর কাছে জানতে চায়? আর দাদি এটা কি? ওটা কি?
বলে শেষ করতে পারে না আশা। বুকে জড়িয়ে নেয় প্রাণের দাদুভাইকে। তারপর ভাবে আশা আমার এত সুন্দর ফুলের বাগান কখনোই যেন ঝড় না আসে।

আষাঢ় চার বছরে পা দেয়। তখন তাদের পরিবারের নেমে এলো মর্মান্তিক বিপর্যয়। আষাঢ় হারালো তার মাকে। পরীর দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হইতে গিয়ে সন্তানকে বাঁচানো গেলেও মারা যায় পরী। বাহার দুশ্চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখে, আমি এখন কি করি। আমার সব তো শেষ হয়ে গেল। এই বাচ্চাকে কিভাবে মানুষ করব। আশা বিলপ করে বলে, আমার ঘরের আলো নিভে গেল। আমার বউ মা আমারে ছাইড়া চইলা গেল। মারে তোর এই বুড়ো মারে কার কাছে রাইখা গেলি। তুই চলে গেলি মা। কী করে সামাল দিমু আমার ছোট দুই নাতিরে। বউয়ের জন্য আশার কান্না দেখে গ্রামের অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। ছোট নাতির নাম রাখে পরশ। আষাঢ় আর পরশ দুই নাতিকে নিয়ে কষ্টের দিন চলেতে থাকে আশার। এখন আষাঢ় স্কুলে যায়। স্কুল থেকে ফিরে এসে ছোট ভাই পরশকে নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে।
বাহার ক্ষেতে খামারে কাজ করে দিন চলে যায়। আশার বয়স বেড়েছে শরীরে আর কুলায় না। আশা ভাবতে থাকে আমার এই দুই নাতিকে নিয়ে আমরা সারাদিন যায়। ঠিকমত সংসারে খেয়াল রাখতে পারি না। এভাবে আর চলে না। ছেলে আমার সারা দিন ক্ষেতে কাজ করে, দু মুঠো ভাত তো ওর সামনে দিতে হয়। ছেলেকে আবার বিয়ে করাবার চিন্তা আসে মাথায়। পাড়া-প্রতিবেশীও আশাকে বলে, সারা দিন তোমার যে খাটুনি যায়। এবার তাহলে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দাও। আশা বলে, তোমরা ভালো কথাই বলছ। আমার এই দুই নাতিকে তো মানুষ করতে হবে। আমার একার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না।

বাহারকে বিয়ে করালো সংসারের কথা চিন্তা করে। দ্বিতীয় বউ মর্জিনা সংসারে আসতে না আসতেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব সংঘাত। সংসারে কর্তৃত্ব তার হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। মর্জিনার ভাবনা সংসার সেই ভালো বোঝে সংসার কি করতে হবে না করতে হবে। আশা নীরবে শুধু দেখা যায়, দুই নাতি ছাড়া তার কোন ভাবনা নেই। বাহারের ক্ষেতের চাষাবাদের জন্য লোক দরকার হয়। তখন মর্জিনা বলে, অন্য লোক রাখার তোমার দরকার কি? তাদের তো টাকা দিতে হবে। অন্যকে দিয়ে কাজ করার দরকার নেই। যেতে দুই পয়সা থাকে সেই ব্যবস্থাই করো। ঘরে তো নিজেরই ছেলে আছে।
বাহার অবাক হয়ে বলে, অতুটুকু একটা ছেলে কাজ করবে, তাহলে আমি বাবা আছি কেন? ওর তো এখন লেখাপড়া করার সময়।
পড়াশোনা বেশি করে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে ক্ষেত-খামারে কাজ করাই ভালো। সারাদিন তোমার কত খাটুনি যায়। একটু বিশ্রাম নিতে পারো না।
বাহার তার বউকে বলে, আমাকে যা বলার বলছো মা যেন এ কথা না শুনে।
কেন আমি কি তাকে ভয় পাই? বুড়া মানুষ তার আবার এসবের নাক না গলানো ভালো।
আশা ছেলেকে বলল, বাবা তোর ছোট ছেলে ভাগ পানি কিছুই খায় না। বাবা তুই তোর মিনু চাচি কাছ থেকে দুধ রোজ করতি? তাহলে নাতিটা আমার দুধ দিয়ে কয়টা ভাত খাই তো। তোর বড় ছেলের খাতা কলম শেষ হয়েছে। সকালে একশো টাকা চাইছিল। আমি বলছি তোর বাবা আসুক বলবোনে। বাহার মায়ের কথার সঙ্গে সঙ্গে একশ টাকা বের করে দিলো, তুমি ওরে খাতা কলম কিনে নিতে বলো। আচ্ছা বাবা আচ্ছা। মা তুমি মিনু চাচিরে দুধের কথা বলো। ছেলেরে টাকা দেওয়া দেখে মর্জিনা রাগে গর্জে ওঠে। মর্জিনা বলে, টাকা চাইল আর তুমি অমনি দিয়া দিলে। আমি তোমারে কি বলছি? ছেলেকে আর পড়ালেখা করাইতে হবে না। আশা বললো, বউ মা তুমি এটা কি বললা? আমার নাতি পড়াশোনা করবে না। আপনি মনে হয় আকাশ থেকে পড়ছেন। পড়ালেখা কইরা কি হইব? তার চেয়ে বাপের সাথে কাজ করলেই ভাল হইবে। আপনার ছেলের দুই পয়সা রোজগার হইবে, আপনি কি তা চান না। আপনি ছেলের দিকে তাকাইবেন না।
আশা বলে, বৌমা আমি কি ছেলের ভালো বুঝি? যত ভালো সে তো বোঝো তুমি? আমার ভালোটা না হয় তুমি বুঝো। মা আর বউ এর কথা কাটাকাটি দেখে বাহারের মুখে কোন কথা নেই, চুপ হয়ে রইল।
আশা একটু দূরে যাইতে মর্জিনা বললো, আমি তোমারে যা বলি, তুমি শুধু শুনে যাবা কোন কথা বলবা না। যদি না মানো সংসারে আমি আগুন ধরিয়ে দেব। বাহার বলল, তুমি যে আমার ছেলেকে কিছু দিলে চেঁচামেচি করে ওঠো। ছেলে তো তোমারও। না, ছেলে আমার না আমি যাকে পেটে ধরিনি সে আমার ছেলে হয় কি করে? আর তোমার ছেলেকে আমার ছেলে বলবা না। তাহলে আমি সংসার ছেড়ে চলে যাব। বাহার এই কথা শুনে আর কথাই বলল না। বাহার নিশ্চুপ হয়ে মর্জিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ছোট ছেলে পরশ ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠছে। দুষ্টামিও বেড়েছে তার। আশা কিছুতেই তার দুষ্টামি থামাতে পারছে না। আশাকে সব সামলাতে হয়। আষাঢ় আছে তার পড়ালেখা নিয়ে। আর মর্জিনা আছে বিমাতার চেনা রূপ নিয়ে। সে কিভাবে দুই পয়সা জমাবে সেদিকে তার চিন্তা। আষাঢ় আর পরশ কোন দোষ করলেই মর্জিনা অমনি মারা শুরু করে দেয়। আষাঢ় অনেক শান্ত আর পরশ একটু চঞ্চল। পরশ একটু দুষ্টু হাওয়াতে, তাই তাকে যখন তখন মার খেতে হয় সৎ মা মর্জিনা কাছে। দাদি আশা সইতে না পেরে নিজেই ঘরের খুঁটির সাথে কপাল ঠোকে। কিইবা করার আছে তার মুখ মুঝে সহ্য ছাড়া। না হলে তো পেটে ভাত জুটবে না। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কাঁদে চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যায় আশার। মর্জিনা গর্ভধারণ করে। গর্ভধারণ কালে বাড়ির সমস্ত কাজের দায়িত্ব এসে পড়ে আশার উপর। মর্জিনা যতœ নিতে কোন ত্রুটি হয় না, তারপরও মর্জিনার মন পাওয়া যায় না। নানা রকমের হুকুম থাকে তার। বিধাতার লীলা বোঝা ভার। বাচ্চার জন্মের সময় মারা যায় মর্জিনা। মেয়ে বাচ্চা জন্ম নেয়ে, বাচ্চার নাম রাখা হয় মিলি। আশার এখন এই তিন নাতিকে নিয়েই দিন রাত কখন যে চলে যায় টেরই পায় না। ছোট নাতি মিলাকে কোলে নিয়ে, আশা আজ মর্জিনার কথা স্মরণ করে বলে, আজ তুমি সন্তান রাইখা কোথায় আছো, কোথায় তোমার বাড়ি, কোথায় তোমার টাকা-পয়সা, সবই তো রেখে গেলে দুনিয়াতে। আহারে সংসার নিয়ে কত বড় কথা বলছে। অন্যের সন্তানকে দেখতে পারোনি। আজ নিজেই সন্তান কোথায়। হায়রে মানুষ না বুঝে কতইনা বড়াই করি। আষাঢ় বোনকে অনেক আদর করে। বোনকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। যেখান থেকেই আসুক না কেন আগে বোনকে কোলে নিবে। বোন ও ভাইকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। পরশ স্কুল থেকে আসা মাত্রই নিজে না খাইয়ে আগে বোনকে খাওয়াবে।

জাহানারা বলল আশাকে, আপা তুমি এখন এই তিন নাতি-নাতনি নিয়ে এত কাজ করতে পারো নাকি। তোমার বাহারকে আবার বিয়ে করিয়ে দাও।
আশা বলে, আমি আমার ছেলেকে বিয়ে করাব না। আমার এই নাতি নাতনিদের আর সৎ মায়ের নির্যাতন সহ্য করব না। ওদের কষ্ট আমি দেখতে পারুমনা।
জাহানারা বলে, তাই বইলা তুমি এইভাবে কষ্ট করবা এই বুড়া বয়সে।
আশা আমি কষ্ট করি তাও ভালো। আমি বাইচা থাকতে আমার নাতিরা কষ্ট করবে তা আমি সহ্য করতে পারবো না।

বাহার বাজার থেকে আসলো, এসে দেখে মা কাজ করছে, মায়ের সাথে সাথে নিজেও সংসারের কাজে লেগে পড়ে। আশা অবাক হয়ে ভাবে, ছেলে আমার যথেষ্ট ভালো, মাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। অথচ এই ছেলেই বউয়ের কথায় মাকে ভুলে যায়। ছেলে আমার বোকাসোকা মানুষ কারো কথায় কোন উত্তরই করে না। আশা ভাবে যত কষ্টই হোক তারপরও এই তিন নাতি আর ছেলেকে নিয়ে ভালোই আছি।
আশা হঠাৎ করে বুকে ব্যথা অনুভব করে তাই সে শুয়ে আছে। আষাঢ় দাদির অসুস্থ দেখে পাগলের মত হয়ে যায়। দাদিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চায় কিন্তু সে যেতে চায় না। নাতির এই হতাশা দেখে আশা বলে, কিরে দাদু ভাই এমন অস্থির হচ্ছিস কেন? আমি তো ভালো আছি। তোরা তিনজনে আমার পাশে বস। ছেলে আর নাতির সাথে অনেক কথাই বলে। তারপর বাহারকে বলে, যা বাবা তুই গিয়ে শুয়ে পর, এরপর আশা নাতিদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাহার সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবে। অথচ সে তার মাকে দেখছে না। কি ব্যাপার মা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। অন্যদিন তো মা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে। বাহার তার মার ঘরে যায়। মা মা বলে ডাকলো, কিন্তু মায়ের কোন সাড়াশব্দ পেল না। তারপর বাহার কাছে গিয়ে দেখল তার মা আর নেই। আশা নিরবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। বাহার কাঁদে মা আমার আর আপনার কেউ রইল না। আষাঢ় আর পরশ তারাও দাদীর জন্য কাঁদলো। মিলি তো ছোট ভালো-মন্দ কিছুই বুঝে না। আশার এই মৃত্যুর খবর শুনে পাড়া- প্রতিবেশী আসলো। বাহার মায়ের জন্য ভেঙ্গে পড়ে, সবাই বাহারকে সান্তনা দেয়, তুমি ভেঙ্গে পড়লে তোমার এই ছোট ছোট বাচ্চাদের কি হবে। বাহারদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তো করতে হবে। তাই পাড়া-প্রতিবেশী একেক জন সবারই ঘর থেকে একেকদিন করে ভাত নিয়ে আসে। বাহারদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা পাড়া-প্রতিবেশী করালো। সবাই একেকদিন করে খাবার দেবার ব্যবস্থা করে। কেউ মারা গেলে সেই বাড়িতে তিন দিন চুলা না জ্বালানোর রেওয়াজ। বাহারের ঘরেও তো রান্না করার মত কেউ নেই। তাছাড়া থাকলেও তো তিন দিন পর্যন্ত চুলা জ্বালানোর নিয়ম নেই।

মায়ের মৃত্যুর পর কয়েক মাস পর বাহার সিদ্ধান্ত এই গ্রামে সে আর থাকবে না। এখানে থেকে শহরে চলে যাবে। মা নেই সংসার বলতে কিছু নেই। কিসের জন্য থাকবে। এরপর জমিজমা বিক্রিয় করে ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ঢাকায় এসে কিছুই তার চেনা জানা নেই। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এরপর একটি বাড়িতে ছোট্ট একটি রুম ভাড়া নেয়। আষাঢ় আর পরশ গ্রাম ছেড়ে ঢাকার এই পরিবেশ তাদের কাছে বন্দীখানা লাগে। তারা তাদের বাবাকে বলে, বাবা ফিরে চলো গ্রাম। আমাদের এখানে ভালো লাগছে না। বাহার ছেলেকে সান্তনা দিয়ে বলে, বাবা কিছুদিন থাকার পর দেখবে ভালো লাগবে।
আষাঢ় বলে, বাবা অচেনা জায়গা আমাদের ভালো লাগছে না। বাহার নানাভাবে ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে বলে। বাবা থাকতে থাকতে একসময় ঠিকই ভালো লাগবে। গ্রামে যে আমরা কি করব, তাছাড়া জায়গা-জমি তো যা ছিল সবই বিক্রিয় করেছি। শুধু আছে থাকার বাড়িটা। এখন আমরা এখানে একটা কিছু করব। আমরা এখানে অনেক সুখ শান্তিতে থাকতে পারবো। আষাঢ় বলে বাবাকে, আমাদের অনেক সুখের দরকার নেই, গ্রামে আমরা অনেক ভালো ছিলাম। বাবারে ওই গ্রামে তো আমাদের কিছুই নেই সবই তো হারাইলাম।

বাহার একটা ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করে। সে ভাবল শুটকি ফেরি করে বিক্রিয় করবে। বাহার ব্যবসা করার জন্য শুটকি কিনে আনলো। এরপর ছেলেকে বলে, বাবা তোমরা বাসায় থাকবা রান্না করবা আর আমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে শুটকি বিক্রিয় করব। তুমি তোমার ছোট ভাই-বোন দুজনকে দেখে রাখবা। আষাঢ় একটু দূরে সাপ্লাই থেকে খাবারের পানি আনে। লাকড়ির চুলায় রান্না করে। তারপর রান্না শেষ হলে। গোসল করার জন্য কুয়া থেকে পানি উঠায়। তারপর ছোট বোন মিলিকে গোসল করিয়ে, ছোট ভাই পরশ আর মিলিকে খাওয়া-দাওয়া করায়। আষাঢ় তার বাবা আসার অপেক্ষায় থাকে। বাবা আসলে তাকে গোসল করার জন্য কুয়া থেকে পানি তুলে দেয়। এরপরে দুজনে মিলে একসাথে সাথে খেয়ে নেয়। আষাঢ় কোন কাজই তার বাবা আর ছোট ভাইকে দিয়ে করে না। সংসারের সমস্ত কাজেই সে নিজে করে। ছোট ভাই কোন কাজ করতে চাইলে আষাঢ়ের অন্তর কেঁপে ওঠে। আষাঢ় বলে, যতক্ষণে এই কাজ তুমি করবে তার আগেই আমি করে ফেলবো। এই ছোট হাতে তোমার কাজ করতে হবে না। তুমি ব্যথা পাবে তাতে আমি ব্যাথা পাব।

শুটকি বিক্রিয় করে বাহারের সংসারটা অনেক সচ্ছল ভাবে চলছিল। ভালোই টাকা জমিয়ে। বাহারের সুখের সংসারটি ভালোই চলছিল। এরই মাঝে প্রতিবেশী তাহেরার চোখে পড়ে যায় বাহারের উপর। তাহেরার বোন ছিল ঘাড়ের উপর। কিভাবে বোনকে বিয়ে দিয়ে পার করা যায়। সেই চিন্তায় ছিল তার। বাহার শুটকি বিক্রিয় করে আসা-যাওয়ার পথে। বাহারকে ডেকে তাহেরা গল্প শুরু করে দেয়। একদিন সরাসরি কথাটা বলেই ফেলে। ভাই আপনার তো বউ নেই। আমার তো বোনকে বিয়ে দিতে হবে। আমার আপনাকে খুব ভালো মানুষ মনে হয়। আপনার কাছে বোনকে বিয়ে দিতে পারলে বোন আমার সুখে থাকবে। আমার বোনও খুব ভালো। বাহার তা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে বলে, আপা কি যে বলেন না আপননি। এরপর থেকেই যাওয়া-আসা চলতে থাকে। আর বাসায় ফেরার পথে তাহেরাকে অনেক জিনিসপত্র খাবার দিয়ে আসে। এরপর তাহেরার বোনের সাথে বাহারের বিয়ে হয়। বাহার বিয়ে কথা ছেলেকে বলতে পারছিল না। এরপর চক্ষুলজ্জা ফেলে আষাঢ়কে বলে, বাব তোর আর কষ্ট করে ভাত রান্না করতে হবে না।
আষাঢ় বলে, বাবা আমার কোন কষ্ট হয়না। এই নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।
বাহার হ্যাঁ রে বাবা আমি বুঝি, তুই না বললে কি হবে। সারাদিন তোর কত কাজ করতে হয়। কুয়া থেকে পানি উঠাতে হয়, দূর থেকে খাবার জন্য সাপ্লাই পানি আনতে হয়, রান্না-বান্না করতে হয়। ছোট ভাই-বোনদের গোসল করানো, ওদের খাওয়া-দাওয়া করানো। সবই তো করতে হয়।
আষাঢ় বলে, বাবা তোমারও তো অনেক কষ্ট করতে হয়। মাথায় বোঝা নিয়ে কত জায়গায় তুমি যাও।

বাহার ছেলেকে নিজের বিয়ের ব্যাপারে বোঝাতে না পেরে, ভাবে কিভাবে যে সেতারাকে ঘরে তুলি। কয়েকদিন পর বাহার সব দ্বিধা-সংকোচ ফেলে সেতারাকে ঘরে তোলে। আষাঢ় তো বাবার এই কান্ড দেখে অবাক। বাবার বিয়ের ব্যাপার মানতে পারছিল না। বাহার ছেলের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে, বাবা আমি তো তোদের ভাত রান্না করে দেওয়ার জন্য একজন মানুষ আনলাম। তোর কষ্ট আমার ভালো লাগেনা। আষাঢ় এরপর কোন কথাই বলে না। আবার শুরু হয় চিরপরিচিত সংসারের সংঘাত। দুদিন যেতেই বাহারকে বলে, ছেলে দুজনকে এভাবে বসিয়ে খাওয়াবা?
বাহার বলে, তাহলে ওরা কি করবে?
সেতারা বলে, আমি যা বলি তোমাদের ভালোর জন্যই বলি। ওরা গার্মেন্টসে চাকরি করবে। আয় রোজগার ভালো হবে। তোমার শরীরও আছান পাবে। ভালো থাকতে গেলে একার কাজে সংসার চলে না। বাহার ওরা তো ছোট এই বয়সে আরাম-আয়েশ করুক।
সেতারা বলে, আর ছোট ছোট বোলো না। আমার কথা তোমার ভালো লাগে না।
বাহার আহা রাগ করো কেনো। আষাঢ় তো চাকরি পাবে কিন্তু পরশ পাবেনা চাকরি।
সেতারা বলল কেন পারবে না?
বাহার ছোট ওকে তো গার্মেন্টসের চাকরিতে নিবেনা। সেতারা বলে, আমার এক ভাই আছে নাম তার ফজলু। তাকে বললে সে চাকরি নিয়ে দিতে পারবে। ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। বাহার এরপর আষাঢ় আর পরশকে ডাকলো। ওরা কাছে আসতেই দুজনকে বলল, বাবা দেখো এইভাবে তো আমার একার রোজগারে সংসার চলে না। তাই বলছিলাম তোমরা দুই ভাই গার্মেন্টস ভর্তি হও। এই কথা শুনে আষাঢ়ের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তারপর বললো, বাবা আমি গার্মেন্টস চাকরি করব পরশ থাক। বাহার বলল, ও আবার থাকবে কেন? সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরবে আর বাদরামি করবে। তার আর দরকার নেই। ওকে হয় তো গার্মেন্টস নেবে না। তোমার মায়ের এক ভাই আছে। সে ওকে গার্মেন্টস চাকরি দিতে পারবে। আষাঢ় তারপর ভাইকের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে ভাবে তোকেও গার্মেন্টসে চাকরি করতে হবে। তারপর দুই ভাই গার্মেন্টস এ ভর্তি হয়।

সেতারা মিলিকে কুয়ার সামনে মারছে। আর মিলি চিৎকার করে কাঁদছে। আষাঢ় আর পরশ বলছে আপনি ওকে মারছেন কেন? সেতার বলছে, মারব না তো কি করব? আমার কি কোন কাজ নাই। সারাদিন এই সংসারের জন্য কাজ করতে করতে দিন যায়। তার মধ্যে ওর জ্বালাতন ভালো লাগেনা। পরশ বলে, আপনাকে আবার ও কি করলো? ভাইয়া তো ওর খাওয়া-দাওয়া গোসল সবই করায়। আপনি কি করেন? সেতারা হ্যাঁ আমি কিছুই করি না। আমার সামনে এসে পানি ধরে, কাদা দিয়ে জামা কাপড় নষ্ট করে। তারপর আষাঢ় মিলেকে গোসল করিয়ে খাওয়ালো আর বলল, আমরা না থাকলে কুয়ার কাছে যাবি না। মিলি বলে, না ভাইয়া আমি যাইনি। মা আমাকে কুয়ার কাছে ধরে নিয়ে মেরেছে। পরশ তখন বলেনি কেন? তোকে কুয়ার কাছে ধরে নিয়ে যে মেরেছে। তুই নিজে যাস নাই। মিলি বলে, ভাইয়া আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। না হলে মা আমাকে আবার মারবে। আষাঢ় মারবে না কোন দুষ্টুমি করবি না খেলবে কেমন। মিলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

আষাঢ় আর পরশ বেতন পেয়ে বোনের জন্য লাল জামা আর খেলনা কিনে আনে। আর বাদবাকি টাকা বাবার কাছে দেয়। সেতারা মিলির খেলনা আর জামা দেখে হিংসায় মরে যায়। স্বামীর কাছে বলে, তুমি ছেলেদের বলো, বেতন পেয়ে যাতে খরচ না করে। সব টাকা যাতে তোমার হাতে তুলে দেয়। বাহার সেতারা কাছ থেকে এই কথা শুনে, ছেলেদের বলে, তোমরা বেতন পেয়ে কোন খরচ করবে না, যার যা লাগবে আমি কিনে দেবো। পরশ বাবাকে বলে, আমরা কোন টাকা খরচ করিনি শুধু ছোট বোনের জন্য কিছু কেনাকাটা করেছি আর সব টাকা তো তোমার হাতে দিয়েছি। সেতারা বলে, ও ছোটটা যে কবে বড় হবে। বড় না হওয়া পর্যন্ত এটা খাবার গিলতে থাকবে। সেতারা দেখে সংসারে আয় রোজগার ভালই হচ্ছে। সেতারা শুধু বোঝে কিভাবে নিজের ঝোলা জাতি করতে হবে। তারপর মিলির লাল জামা লুকিয়ে রাখে, নিজের বোনের মেয়েকে দেবে বলে। মিলি শখের লাল জামা না পেয়ে কাঁদতে থাকে। সেতারা মিলির কাছ থেকে জামা হারানোর কথা শুনে মিলিকে কান্না অবস্থায় মারতে থাকে। মিলিকে একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় দরজার উপরে পড়ে মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। সেতারা ওই অবস্থায় মিলিকে তুলেও না। মিলি ওই অবস্থায় ওখানেই পড়ে থাকে। আষাঢ় আর পরশ এসে দেখে মিলি কোন কথা বলছে না। মাথা থেকে রক্ত পড়া অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। আষাঢ় মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার মিলিকে দেখে বলে, ছোট বাচ্চা মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে। ডাক্তার জানতে চায় আপনারা সাথে সাথে নিয়ে আসেন নেই কেন? আষাঢ় বলে, তা জেনে লাভ নেই। আমার এখন বোনের সুস্থতার কথা শুনতে চাই? ডাক্তার বলে, ধৈর্য হারা হবেন না। এই বাচ্চার রক্ত লাগবে। আষাঢ় বলল, ওর আর আমার রক্তের গ্রুপ এক। আপনি আমার শরীর থেকে রক্ত নিন। এরপর আষাঢ়ের শরীর থেকে মিলিকে রক্ত দেওয়া হয়। তারপর সুস্থ হয়ে মিলিকে নিয়ে বাসায় আসে। বাসায় আসলে মিলি তার মাকে দেখে ভয় পায়। আষাঢ়কে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মা তাকে মারেছে। সেতারা তা দেখে বলে, দেখেছো দেখেছো এইটুকু বাচ্চা মেয়ে সে কি আমার নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলে। এই মেয়ের জন্য আমি আর ভাত রান্না করবো না। আষাঢ় বলে, ওর জন্য আপনি যদি ভাত রান্না করতে না পারেন। আপনার কারো জন্য ভাত রান্না করতে হবে না। আপনি চলে যান এখান থেকে। সেতারা কান্নাকাটি করে মানুষ জড়ো করে ফেলে। শোনেন আপনারা এই ছেলে বলে কি? তার মধ্যে কেউ একজন বলে, তার সাথে সেতারার খুব খাতির। মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে, সৎ মা হলেও সে তোমার মা। পরশ বলে, আপনি দেখছেন না। সে আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করছে। আমার এইটুকু বোন তার সাথে সে যে রকম জুলুম অত্যাচার করে, তা কি সে খুব ভালো করে? সেতারা বলে, আসুক আজ বাসায়। এর একটা বিহিত করতে হবে। পরশ হ্যাঁ এই নালিশ ছাড়া আপনারা আর আছে কি? আপনি এতক্ষণ যা বলছেন তাতে তো আপনার হয় নেই। আবার স্বামীর কাছে কান্নাকাটি করে বলবেন। না বললে তো আপনার পেটের ভাত হজম হয় না। এরই মাঝে বাহার আসে। সেতারা খুব কান্নাকাটি করে বলে, তোমার ছেলেরা আমারে যা ইচ্ছে তাই বলে। আমার মুখের উপর কথা বলে, আমার মা বলে, সম্মান করে না। জিজ্ঞেস করো? হোসনেরা আপার কাছে। হোসনেরা হ্যাঁ ভাইজান যা দেখলাম। আপনার দুই ছেলে যা বলল, তা মানুষ হয়ে মানুষকে বলে না। বাহার ছেলেকে কাছে ডেকে বলে, তোমার মায়ের সাথে এরকম করলে সে তো সংসার রাইখা চলে যাবে। আষাঢ় বলল, বাবা আগে আপনি আপনার সংসার বাঁচান। না হলে সে তো চলে যাবে। হ্যাঁ বাবা ছেলে গেলে ছেলে পাবেন। স্ত্রী তো আর পাবেন না। হোসনেরা খালা যা বলার তা তো সে সত্যি বলছে। হোসনেরা খালা তো শুটকির পাওয়ার লোভে। ভালো ভাবেই মিথ্যা কথা বলল। হোসনেরা বলে, দেখেন আপা আপনার ছেলে বলে কি? আমি নাকি লোভের জন্য মিথ্যা কথা বলছি। সেতারা স্বামীকে বলে, তোমার ছেলেরা কামাই করে বলে, তাই এত বড় বড় কথা বলে। আষাঢ় বলে, বাবা আমাদের দুই ভাইকে ধরে পিটাও। তাহলে তার পরান ঠান্ডা হবে। বাহার বলে, তোমরা দুই ভাই তোমার মায়ের কাছে পা ধরে ক্ষমা চাও। পরশ বলে, বাবা মারার যদি প্রয়োজন হয়, তুমি আমাদের দুই ভাইকে মারো। তাও আমরা উনার কাছে ক্ষমা চাবো না। সেতারা বলে, দেখেছো দেখেছো ছেলেদের তেজ কি। মিলি বিছানায় শোয়া মাথায় বেন্ডিস দেখে কোন কথাই বাহার জিজ্ঞেস করল না। মিলির মাথায় কি হয়েছে, মাথায় ব্যান্ডিস কেন? আষাঢ় বলল, পরশ শোন ভাই আমার বাবাকে তার মতো করে থাকতে দেয়। তাকে কোনো কথা বলে লাভ নেই, বাবা আমাদের কথা শুনবেন না। স্ত্রী যা বলে, তাই সে বিশ্বাস করে। পরশ বলে, আমরা সারাক্ষণ থাকি অফিসে মিলিকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা। আষাঢ় বলল আমরা দুই ভাই থাকতে মিলির কষ্ট হবে কেনো? সেতারা নিজের কন্যা সন্তান হওয়ায় তাকে নিয়েই ব্যস্ততায় দিন কেটে যায়। তাকে খুব আদর যতœ করে তা দেখে মিলি তাকিয়ে থাকে। এই ছোট্ট মিলির ভাত রান্না করে, এই সময় চুলার জ্বাল নিভে যায়। সেতারা জ্বাল নিভে যাওয়া দেখে চুলার লাঠি দিয়ে মিলির পা পুড়ে দেয়। মিলি কেঁদে বলে, মা আমারে এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচাও। সেতারা মিলির গাল ধরে বলে, যদি আজকের ঘটনার কোন কিছু তোর বাবা আর ভাইদের কাছে কিছু বলছিস। তাহলে তোকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলব। ছোট্ট মিলি মায়ের এই কথার ভয়ে বাবা আর ভাই আষাঢ় আর পরশ তাদের কাছে কিছুই বলে না। ব্যথার যন্ত্রনা কাঁদতেও পারছে না। আষাঢ় দেখে মিলির চোখে পানি টলমল করছে। আষাঢ় জিজ্ঞেস করল তোর চোখের পানি কেন? মিলি কোন কথাই বলে না। তারপর আষাঢ় বলে, আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া কর। মিলে বলে, ভাইয়া আমাকে খাইয়ে দাও। আষাঢ় মিলিকে ভাত খাইয়ে দেয়। সেতারা বাহারকে বলে, আমার খাটতে খাটতে সারাদিন যায়। এই ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে সাপ্লাই থেকে পানি আনা, কুয়া থেকে পানি তোলা। রান্না করা কাপড় কাচা ঘর-দুয়ার ঝাড়– দেওয়া সবই তো আমাকে করতে হয়। তোমার মাইয়া মিলিত কিছুই করে না। সারাদিন শুধু খাওয়া আর খাওয়া। এছাড়া আর তার কাজ নেই।

মমতাময়ী মায়ের মিথ্যা আশ্বাস নিয়ে মিলিকে ভালোবাসার মায়া জালে ফেলে বলে। মিলি শোন আমি না তোর জামা ধোয়ার জন্য কুয়াতে নিছিলাম। জামাটা না কুয়াদে পড়ে যায়। এখন কি যে করি, চল তুই আর আমি কুয়া থেকে জামাটা তুলি। আজকে তোকে আমি গোসল করিয়ে দেবো। মিলি মায়ের কথা মত কুয়া কাছে যায়। কুয়ার মধ্যে জামাটা দেখা যাচ্ছে। জামাটা দেখে কেঁদে দেয় মিলি। দাঁড়া আমি জামাটা তোলার ব্যবস্থা করছি। তোকে বালতির করে কুয়ার মধ্যে ধরবো। পরে আমি রশি ধরে রাখবো। তুই জামাটা তুলবি। মিলি প্রথমে কুয়ার মধ্যে নামতে রাজি হয় না। এরপর মিলি সরল মনে মায়ের কথা মতো কুয়ার মধ্যে নামতে রাজি হয়। কিন্তু সেতারার মনের মধ্যে ছিল চালাকি। এরপর মিলিকে সেতারা কুয়া থেকে তুলে না। মিলি কাঁদে মা আমাকে তোলো। সেতারা তার হাত থেকে রশি ছেড়ে দেয়। মিলি কুয়ার পানিতে ডুকে যায়। একজন মায়ের মন সন্তানের জন্য যে ব্যাকুলতা আকুলতা থাকে। সেই মায়া মমতার জাগারণ আষাঢ়, পরশ, মিলির, জন্য কখনোই সেতারার মনে জাগেনি। সেতারা নিজের সন্তান ছাড়া, এই সন্তানদেরকে নিজের সন্তান ভাবতে পারেনি। এরপর কুয়াতে একজন গোসলের জন্য আসে। এসে দেখে কালো চুল আর লাল কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। তখন সে কুয়ার ভেতর থেকে বালতিতে করে উপরে তোলার চেষ্টা করে। তুলতে গিয়ে দেখে বালতি ভারী লাগছে। এরপর বালতি তুলতেই দেখে একজন শিশু। শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মিলি। সে চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। সবাই এসে দেখে মিলির লাশ। লাঞ্চের সময় হওয়াতে আষাঢ় আর পরশ বাসায় আসে। এসে দেখে কুয়ার সামনে অনেক লোকের ভিড়। এরপর দেখে মিলির লাশ আষাঢ় আর পরশ বোনকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল। কিভাবে আমার বোনের এই অবস্থা হলো। এত লোকের ভিড় কিন্তু সেতারাকে তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট বোনটা আমার এত নির্যাতন সহ্য করছে। তাও আমরা কিছু বলিনি। যদি বলি ওর প্রতি আরো নির্যাতন বেড়ে যাবে। আমরা থাকি না বাসায়। আমার বোনটাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়ে রেখেছে। আমরা সব জানতাম জেনেও না জানার ভান ধরতাম। এইটুকু বোন আমার সারাক্ষণ নির্যাতনের উপর থাকতো। সমস্ত কাজ তো ওই করত। এত কষ্ট সহ্য করার পরোও আমার বোনের লাশ দেখতে হইল। আষাঢ় জিজ্ঞেস করল সেতারার কাছে আমার বোন কুয়াতে পড়লো কিভাবে? সেতারা বলল, আমি জানবো কি করে? আমি তো সারাক্ষণ থাকি সংসারের কাজ নিয়ে। সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে আমার তো দম নেওয়ার সময় নেই। আষাঢ় বলে, সংসারের কাজ তো আমার বোন করতো। সারাক্ষণ তো আপনার একটাই কাজ ছিল নিজের স্বার্থ দেখা। বাহার মেয়ের মৃত অবস্থায় দেখে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল কোন কিছুই বলার ছিলো না তার। আষাঢ় কেঁদে বলল, সকালবেলা মিলি আমাকে বলে, ভাইয়া আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। কে জানত আমার বোনকে এসে লাশ দেখতে হবে। মিলির মৃত্যুর পর আশেপাশের লোকজন বলছে, মেয়েটা বেঁচে থাকতে কতই না কষ্ট করেছে। পরশ বলছে, এখন আপনারা কেন বলছেন? বেঁচে থাকতে তো বললেন নেই। এখন মরে যাওয়ার পর বলছেন? সবাই কেঁদে বলল, সেতারাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই মহিলা মেয়েটির পা পুড়ে দিয়েছিল চুলার আগুন দিয়ে। এইটুকু ছোট্ট একটা মেয়ে মুখ বুজে নীরবে সহ্য করছে। আষাঢ় বলল, আমার বোনের পা পুড়ে ছিল। আমার বোন তো বলে নাই। এই মহিলার অনেক অত্যাচার আমার বোন সহ্য করছে। আমরা অনেক কিছুই জানতাম কিন্তু তারপরও বলতাম না। তাহলে আমার বোনের উপর অত্যাচার বেড়ে যাবে। বাহারকে প্রতিবেশীরা বলে, কেমন বাবা সন্তানের ভালো-মন্দ কিছুই বুঝেন না। শুধু বউয়ের কথা ওঠেন আর বসেন। হঠাৎ করেই ঘটে যায় আরেক দুর্ঘটনা। সেতারা কোলে তার মেয়ে ছিলো। কুয়ার পাশে দাঁড়াতেই, পা পিছলে সেতারার কাছ থেকে তার বাচ্চা মেয়েটা কুয়াতে পড়ে যায়। আর্তনাদ করে ওঠে সেতারা বলে, হায় হায়রে অন্যের জন্য ক্ষতি করলে সেই ক্ষতি যে নিজের জন্য হয়। আজ আমি বুঝতে পারলাম। কে কোথায় আছো আমার বাচ্চাকে কুয়া থেকে তোল তোমরা। আমি ভুল করেছি মিলিকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি মিলির পা আগুনে পুড়ে দিয়েছিলাম। ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। চিৎকার করে বলে, অন্যের সন্তানের জন্য মৃত্যু কামনা করে আজ আমার নিজের সন্তানের মৃত্যু হলো। বাবা আষাঢ় বাবা পরশ তোরা আমাকে ক্ষমা করে দেয়। আমি কোন সময় তোদের সাথে ভালো ব্যবহার করিনি। মা হিসেবে তোদের কখনো মায়া মমতা স্নেহ দেইনি। এরপরে পুলিশ আসে সেতারাকে ধরে নিয়ে যায়। এদিকে আষাঢ় আর পরশ মিলে মিলি আর ছোট্ট শিশুর মৃত লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বাহার ছেলেদের বলে, বাবা সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হইছে। আমাকে তোদের সাথে নিয়ে চল, আমি তোদের সাথে যাব। তোরা ছাড়া আমার কে আছে বল। আষাঢ় আর পরশ বাবার কথায় মন নরম হয়ে যায়। তখন তারা তার বাবাকে সাথে নিয়ে গ্রামে যায়। গ্রামে এসে বাহার তার মা আর স্ত্রীর কবরের পাশে মিলি আর ছোট্ট শিশুকে কবর দেয়। এরপর তারা গ্রামে বসবাস শুরু করে। ক্রমে ক্রমে তাদের আঘাতপ্রাপ্ত হৃদয়ের ক্ষত প্রশমিত হতে থাকে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *