আঘাত হানছে বুলবুল

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

* মহাবিপদ সঙ্কেত
* দোয়া চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
* মোকাবেলার প্রস্তুতি সম্পন্ন
* অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল বন্ধ
* ২৪ ঘণ্টা তান্ডব চালাবে

 


বিজ্ঞাপন

মহসীন আহেমদ স্বপন : অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বিধ্বংসী রূপ নিয়ে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে; জারি করা হয়েছে মহাবিপদ সঙ্কেত। ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিবায় নিয়ে বুলবুল শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ সুন্দরবন হয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের কাছে চলে এসেছে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্র বাতাসের গতিবেগ ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে কলকাতায় ঝড়ো বাতাসসহ ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এদিকে, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা কর্তৃপক্ষ। তীব্র গতিতে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। শনিবারই রাজ্যে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানায়, বুলবুলের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে আগামী ২৪ ঘণ্টা ভারী বৃষ্টির পাশাপাশি দমকা বাতাস বয়ে যেতে পারে।
বুলবুলের প্রভাব পড়বে রাজ্যের রাজধানী কলকাতাতেও। বিভিন্ন জায়গায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক রয়েছে কলকাতা পুলিশ ও দুর্যোগ বিপর্যয় বাহিনী। ঘূর্ণিঝড়টি মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পাশ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশা।
স্থানীয়রা বলছে, বুলবুলের অবস্থান গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্রও তৈরি করা হয়েছে। এরইমধ্যে, বুলবুল মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশায় অন্তত ৩৪টি দল পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় বুলবুল প্রবল আকার ধারণ করে ভারতের সুন্দরবন অংশের দিকে ধেয়ে আসছে। ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে বাংলাদেশেও। বড় ধরনের বিপর্যয় রোধে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় জেলাগুলোতে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি স্থানীয়দের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে বলেছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ মোকাবেলায় সরকারের সবধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে মানুষের জানমালের বেশি ক্ষয়ক্ষতি না হয় সেজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।
শনিবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় শ্রমিক লীগের ১৩তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যের শুরুতে তিনি এই আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ঝড় মোকাবেলার জন্য সবরকমের প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া আছে। এমনকি ঝড় পরবর্তী রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সবধরনের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি।
জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানবে বলে ওই সময় উপকূলজুড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস।
তিনি দুপুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, জোয়ার শুরু ৫টায়, পিক টাইম ৯টায়। এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের নি¤œাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টি ঝরছে; আবহাওয়ায় রয়েছে অনেকটা গুমোট ভাব, যা আইলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে উপকূলবাসীকে।
১০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও সুন্দরবন এলাকায় আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। সেই ঝড়ের শক্তি ছিল বুলবুলের মতোই।
বুলবুলের তা-বে সুন্দরবনের ক্ষতির শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ভারতীয় আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলছেন, বাতাসের গতিবেগে থাকবে অনেক। তবে সুন্দরবন অনেকটাই প্রোটেক্ট করবে।
ঝড় মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নিয়েছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ। উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার ১৮ লাখ মানুষকে সন্ধ্যার আগেই ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য বিভাগের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
মহাবিপদ সঙ্কেত জারির পর সমুদ্রবন্দরগুলোতে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; অভ্যন্তরীণ নৌপথেও চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার দুপুর ১২টায় মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১৫ কিমোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং কক্সবাজার থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বলেন, প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৮-১২ কিলোমিটার করে এগোচ্ছে বুলবুল। ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে উপকূলের কাছাকাছি আরও কাছাকাছি আসবে। এর প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ার বেগও বাড়বে। সন্ধ্যা নাগাদ খুলনা উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঝড়টি।
আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার, যা ১৩০ কিলোমিটার থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
শনিবার সকালেই বাগেরহাটের মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। তবে কক্সবাজারে আগের মতোই ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সঙ্কেত বহাল রয়েছে।
উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নি¤œাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর থাকবে ৯ নম্বর বিপদ সঙ্কেতের আওতায়।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি : ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে মোংলা, চট্টগ্রামসহ সব সমুদ্রবন্দরে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সার্বিক প্রস্তুতির তথ্য নিয়ে শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ৩ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যার আগেই ১৮ লাখ মানুষকে ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিপ্তরের মহাপরিচালক শাহাদৎ হোসেন সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ সাত জেলাসহ যে সব জেলা দুর্যোগপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো থেকে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করে প্রস্তুতি সাজানো হয়েছে।
বলার পরও যারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না, তাদের নিতে বাধ্য করতে পুলিশ নামানো হয়েছে বলে জানান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণ তৎপরতার জন্য। পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ২০০০ প্যাকেট করে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে এবং ২২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করছে।
উপকূলীয় ১৩ জেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জেলার সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা গঠন করেছে ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম।
ঝড় এগিয়ে আসায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল শনিবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। শনিবার আরেক ঘোষণায় সোমবারের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে তা পরে জানানো হবে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের উদ্ভব : সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণম-লীয় ঝড় মাতমো গত অক্টোবরের শেষে ভিয়েতনাম হয়ে স্থলভাগে উঠে আসে। সেই ঘূর্ণিবায়ুর অবশিষ্টাংশই ইন্দোনেশিয়া পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে এসে আবার নি¤œচাপের রূপ নেয়।
বার বার দিক বদলে নি¤œচাপটি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে এসে বুধবার রাতে তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় বুলবুল।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত তালিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলের ঝড়ের নাম দেওয়া হয়। বুলবুল নামটি নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *