গণপরিবহনে হয়রানির শিকার ৯৪ ভাগ নারী

অপরাধ এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : দেশের ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ নারী প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রের জন্য ছুটেন। তাদের অধিকাংশেরই যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছে গণপরিবহন। আর পাবলিক প্লেসসহ যাতায়াতে এই ২৭ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে যৌন হয়রানির পরিমাণটাই সব থেকে বেশি।
শনিবার বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআবি) ‘গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানান ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের জেন্ডার স্পেশালিস্ট হোসনে আরা বেগম।
তিনি বলেন, আমরা সমান অধিকারের কথা বললেও সমঅধিকার নীতি এখনো করতে পারিনি। এছাড়া শুধু গণপরিবহন নয়, নারীর চলাচলের সবদিকগুলোই আমাদের ভাবতে হবে। আমরা গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার কথা বলছি, একই সঙ্গে রাস্তায় তাদের সম্মান দেওয়ার কথা।
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের এই হয়রানিতে যুবকদের থেকে প্রাপ্ত বয়স্কদের পরিমাণই বেশি। আর পরিবহনে হয়রানির পর শুধু কয়েকটি সংগঠন বা কয়েকজন নারীই প্রতিবাদ করেন। তবে, এদের সঙ্গে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা বা ধর্মীয় সংগঠনেরও এগিয়ে আসা উচিত।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আয়োজনের এ গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের প্রধান ডা. কামরান উল বাসেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিকী, বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আলী রেজা, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া এবং ধারণাপত্র পাঠ করেন নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, গণপরিবহন এখন আর গণপরিবহন নেই, তা এখন বাণিজ্যিক পরিবহন হয়েছে। সেই জায়গাটা থেকে এই সেক্টরের সবাইকে গণপরিবহনে নারীদের ‘মা ও বোন’ ভাবা বন্ধ করে ‘যাত্রী’ হিসেবে ভাবতে হবে। তাহলে অধিকারের সমান পর্যায়টা আসতে পারে এবং হয়রানি কিছুটা কমতে পারে। এছাড়া পরিবহনের শ্রমিকদেরও তাদের যথাযত সম্মান যাত্রীদের দেওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, আমরা শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ভুলে গিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। আর পরিবহনে ড্রাইভার-হেলপারদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটা ভয়াবহ হয়। প্রায় প্রতিদিন ড্রাগ নেওয়ার ফলে তাদের একটা সমস্যা থেকেই যায় যেখান থেকে তারা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। আরেকটি বড় ব্যাপার হলো মেয়েদের কথা না বলা। তারা যদি হয়রানি সম্পর্কে কথা বলে, তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান হয়। সে স্বাভাবিকভাবে পাশের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ‘সেফটি স্পেস’ তৈরি করে রাখতে পারে। এজন্য কথা বলাটা জরুরি। একইসঙ্গে নারী-পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখা প্রয়োজন।
ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের প্রধান ডা. কামরান উল বাসেত বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নিয়ম-কানুন হচ্ছে। এখন থেকেই এগুলোর সঙ্গে নারীদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে সঠিক উন্নয়নটা হবে না। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানসিক উন্নয়ন হয়নি। সরকারিখাতে এখন অবধি কতজন আছেন যারা নারীচালক? আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে ড্রাইভারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবারও দেখার বিষয়।
বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আলী রেজা বলেন, আমরা গণপরিবহনের উন্নয়ন, নারীদের নিরাপত্তার কথা সেমিনার করে বলি। ড্রাইভারদের একটি সভাকক্ষে, সভায় ডেকে নিয়ে শেখায়। কিন্তু এতে করে কতজনের কাছে পৌঁছানো যায়? আমাদের উচিত টার্মিনালগুলোতে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা। তাদের কাছ থেকে সমস্যার সমাধান চাওয়া। এতে করে সমাধানের কিছু পথ যেমন আসবে, তেমনি একসঙ্গে বার্তা পৌঁছাবে তাদের অনেকের কাছে।
বিআরটিসির পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, আমাদের সব চালকদের দুই সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ করানো হয়। নারী, শিশু এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিআরটিসির প্রতিটি বাসে ১৫টি আসন সংরক্ষিত। এছাড়া যাত্রী ওঠা-নামার ব্যাপারে যাত্রী যদি সচেতন হয়, তবে সমস্যা আরও কমে। আমাদের দুই দরজার বাসের পেছনের দরজাটি শুধুমাত্র যাত্রী ওঠার জন্য এবং সামনেরটি নামার জন্য। অথচ যাত্রীরা দুইটি দরজাই ওঠা-নামার কাজে ব্যবহার করে। এখানে যাত্রীদের সচেতন হওয়া এবং মানসিকতা পরিবর্তন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
এছাড়া বাসের সিটপ্ল্যান, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, বাসের হাতল, প্রশাসনিক সাহায্যসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে এই বৈঠকে।
এতে সমাপনী বক্তব্য এবং ধন্যবাদ জানান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট ও ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *