“মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে” ট্রু ইভেন্টের আলোকে চিত্রায়িত হলেও বাস্তব জীবনের সাথে সিনেমার অনেক খামতি প্রকাশ হয়ে গেছে

Uncategorized আন্তর্জাতিক জীবনী বিনোদন বিশেষ প্রতিবেদন

মিলি সুলতানাঃ   ইন্ডিয়ান এবং নরওয়েজিয়ান কালচারের মুখোমুখি সংঘর্ষপূর্ণ চলচ্চিত্র “মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে” দেখে রানী মুখার্জির সুনিপুণ অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু মনে স্বস্তি পাইনি। সিনেমার ধর্ম অনুযায়ী হ্যাপি অ্যান্ডিং হলেও মনে সন্দেহ ছিল –আসলেই কি বাস্তবতা সিনেমার মত ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বেশ একটু খাটাখাটুনি করতে হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

“মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে” ট্রু ইভেন্টের আলোকে চিত্রায়িত হলেও বাস্তব জীবনের সাথে সিনেমার অনেক খামতি প্রকাশ হয়ে গেছে। ক্রিটিকসরা ব্যস্ত ছিলেন ঘটনার গভীরতা খুঁড়ে নেয়ার কাজে। অর্থ্যাৎ পর্দায় যা আমরা দেখেছি রিয়েলিটিতে তা ঘটেনি।

যা আমরা দেখতে চাই আমাদেরকে তা-ই দেখানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাস্তবের সাগরিকা চট্টোপাধ্যায় এখনো কঠিন সংগ্রাম করছেন। তিনি বর্তমানে ভারতের পুনে শহরে একা বসবাস করছেন। সেখানে তিনি চাকরি করছেন। বাচ্চারা তাদের নানা নানির সাথে আছে। অর্থাৎ আজো সাগরিকা চট্টোপাধ্যায়ের জীবন সংগ্রাম চলছে তো চলছে।

সাগরিকা ২০০৭ সালে তার স্বামী অনুরূপ ভট্টাচার্যের সাথে নরওয়েতে চলে যান কারণ পরবর্তীতে সেখানে একজন ভূ-পদার্থবিদ হিসেবে চাকরি পান। সাগরিকা তাদের সংসারে দুটি বাচ্চার জন্ম হয়- একটি ছেলে অভিজ্ঞান এবং একটি মেয়ে ঐশ্বরিয়া। দুটি শিশুর জন্মের পরই ভট্টাচার্যের পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ট্র্যাজেডি নেমে আসে।

২০১১ সালে নরওয়েজিয়ান চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিসেস “আনফিট প্যারেন্টিং” বলে দম্পতির দুই সন্তানকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। নরওয়ে সরকার এমন নিষ্ঠুরতম আইন চালু করেছে তাদের দেশে, যা খুবই ন্যাক্কারজনক। এই সিনেমার মাধ্যমে যা যা দেখলাম তাতে করে নরওয়েজিয়ানদের আমার কাছে মানুষ বলে মনে হয়নি।

বিধাতা প্রদত্ত প্রাণ তারা লাভ করলেও তাদের শরীরে “হৃদয়” নির্মাণ করতে ভুলে গেছেন বিধাতা। মায়ের কাছ থেকে এভাবে দুধের সন্তান ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধ কোনো সভ্য দেশ কর‍তে পারেনা।

আমি যে দেশে থাকি (আমেরিকা), এখানে নরওয়ের মত এমন বাজে সিস্টেম নেই। আমেরিকায় এটা রীতিমতো “ক্রুয়েল ক্রাইম”!! আমেরিকায় সবকিছুতে মা’কে প্রাধান্য দেয়া হয়। মায়ের কষ্ট হবে–এমন দিক আমেরিকাতে নেই। আমেরিকায় আমি সর্ব পর্যায়ের নাগরিক সুবিধা ভোগ করছি। এদেশে একজন মায়ের ডিগনিটিকে প্রেফারেন্স দেয়া হয়।

যদিও নরওয়ের রাষ্ট্রদূতকে এই ছবির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিতে দেখলাম। তিনি বলেছেন, সাগরিকা নিজের হাতে করে সন্তানদের যে খাইয়ে দিতেন। নিজের দুধের শিশুদেন নিয়ে শুতেন এক বিছানায়, তাতে আপত্তি ছিল নরওয়ের প্রশাসনের। শিশুর সুরক্ষা একটি বড় দায়িত্বের বিষয়। সেটি কখনওই পেমেন্ট দিয়ে বোঝানো যায় না। তবে এই ছবিতে নরওয়েকে খারাপভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ফিরে আসি মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’তে। নরওয়েজিয়ান চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিসেস সাগরিকার সন্তানের জন্মের পরে দম্পতির উপর কঠোর নজরদারি রেখেছিল। ওই সংস্থার মতে, দেবিকা (রানী মুখার্জি) ও অনিরুদ্ধ (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) এমন কিছুতে লিপ্ত হয়েছিলেন যা শিশু নির্যাতনের মধ্যে পড়ে।

রানীকে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তার বাচ্চাদের যত্ন নিতে অক্ষম বলে শক্তিশালী অভিযোগ তোলা হয়। এই দম্পতি ভারতীয় পিতামাতা। তারা বাচ্চাদের নিয়ে একই বিছানায় শুতেন। বাচ্চাকে হাতে খাইয়ে দিতেন। সাধারণত খাওয়ার সময় বাচ্চারা ঝামেলা করে, খেতে চায়না। তখন আমরা বাচ্চাকে হালকা ধমক দিয়ে খাইয়ে দিই, এটা খুবই ন্যাচারাল। রানী মুখার্জির হিন্দু ঐতিহ্য ও আচার অনুষ্ঠানের রীতিনীতিতে ক্ষুব্ধ হন নরওয়েজিয়ানরা।

ভারতীয় এই জিনিসগুলো নরওয়েজিয়ান সংস্কৃতির জন্য বিজাতীয় এবং হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হয়েছিল। ফিল্মের নরওয়েজিয়ান কারেক্টারগুলো স্পষ্টভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ এবং মানবিক ত্রুটির অবগুণ্ঠনে আবৃত ছিল। একজন ছিন্নভিন্ন নিপীড়িত মায়ের চরিত্রে রানী মুখার্জি অসামান্য অভিনয় করেছেন। যাকে তার স্বামীর হাতে ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হতে হয়েছিল। শুধু হৃদয়হীন স্বামী নয়, শ্বশুর শাশুড়িও রানীর উপর ঘরালু সহিংসতা চালিয়েছেন।

একজন দেবিকা (রানী) কিভাবে শুধুমাত্র নিজের আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে নরওয়ের অমানবিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। একজন সাধারণ ভারতীয় বধূর সাঁড়াশি আক্রমণ ও ঝাঁকুনির তীব্রতা সহ্য করতে পারেনি নরওয়ে নামক দেশটি। বিশ্বব্যাপী সমালোচনার খোরাক হয়েছিল নরওয়ে। দেবিকার (রানী মুখার্জি) বুক বিদীর্ণ করা হাহাকার আমার অশ্রুপাত ঘটিয়েছিল।

আবার দেবিকার কিছু অজ্ঞতাকে আমি এড়িয়ে যেতে পারছিনা। যেমন, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ব্যক্তিরা যখন দেবিকার বাসায় অবস্থান করছিলেন, তখন দেবিকা কেন আচার আচরণে সতর্ক হননি? “আনস্টেবল অ্যান্ড আনফিট মাদার” এর বদনাম কুড়ানোর রিস্ক পিরিয়ড যেহেতু চলছিল তখন কেন তিনি স্বামীর (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়েছেন?? আচরণ চলাফেরা সংযত রাখা উচিত ছিল দেবিকার।

তবে একটা দৃশ্য ছিল, দেবীকার মা বাবা কলকাতা থেকে নরওয়ে হাজির হন মেয়ের খারাপ সময়ে তার পাশে থেকে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। দেবিকার মা বাবার সামনে অনিরুদ্ধ যখন (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) দেবিকার গালে থাপ্পড় মারলেন। থাপ্পড় খেয়ে দেবিকা দমলেন না।

ফিরতি থাপ্পড় লাগালেন স্বামীর মুখে। আর এই দৃশ্যটা অত্যন্ত ভালো ছিল। নারী কেবল পড়ে পড়ে মার খেয়ে যাবে, সেই দিন আর নাই। ইট মারলে যে পাটকেলটি খেতে হয়, ফিল্মের দেবিকা দর্শকদের উদ্দেশ্যে সেই মেসেজটাই দিলেন। ফিল্মে হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ডায়লগ ভালো লেগেছে। কলকাতার মেয়ে রানী মুখার্জির হাস্কি ভয়েসে বাংলা ডায়লগ খুবই ভালো লেগেছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *