!! মন্তব্য প্রতিবেদন !!  দ্যা কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স!! 

Uncategorized খুলনা জাতীয় জীবনী বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

চিত্র শিল্পী এস এম সুলতান।


বিজ্ঞাপন

বিশেষ প্রতিবেদক ঃ  বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমজীবী সমাজকেই, গড়ে ওঠা বাঙালি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে যারা পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরে একাত্তরের ইতিহাস পট রচনার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এস এম সুলতান ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। তার পিতা প্রথমে কৃষক এবং পরে রাজমিস্ত্রী হিসেবে ছিলেন অর্থাৎ বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের মধ্যে তিনি নিম্ন শ্রেণীর কাজ করতেন।

এস এম সুলতান ছোটোবেলা থেকে কৃষক বা শ্রমজীবী সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ঘর থেকে পালিয়ে কলকাতা এবং পরে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তার নানন্দিক ছবি আঁকার প্রতিভার কারণেই সেইখানে তিনি হোসেন সোহ্‌রাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন। তাকে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তিও করিয়ে দিয়েছিলেন তার অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে। শৈশবে তিনি লাল মিয়া নামে পরিচিত থাকলেও সোহ্‌রাওয়ার্দীই তাকে এস এম সুলতান নামকরণ করছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই কলেজেই আরেকজন প্রতিভাবান শিল্পার্চার্য জয়নুল আবেদিন পড়াশোনা করছিলেন।

বোহেমিয়ান জীবনযাপনের মনোভাব থাকার দরুন তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে পড়াশোনা শেষ না করেই আবার দেশভ্রমণে বের হয়েছিলেন। করাচী, কাশ্মির, সিমলা এবং ভারতের নানান যায়গায় তিনি ছবি এঁকে প্রদর্শনীর মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য অর্থ উপার্জন করতেন। এক সময় তিনি বেশ কিছু উঁচু মানুষের নজরে আসেন, যাদের সাহায্যে তাকে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, শিকাগোর মতোন যায়গায় তার ছবির প্রদর্শনী করার জন্য নিমন্ত্রণ পাইছিলেন। তিনি দেশ ত্যাগ কইরা বিদেশে গেলেন। তার ছবি বিভিন্ন আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হইছিল। সেখানে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পাইলেন।

উপরে এস এম সুলতানের জীবনের প্রারম্ভিকতার সারকথা তুলে ধরার কারণ হইল, এই লোক সম্পর্কে আমরা খুব বেশী কিছুই জানি না। তাকে কখনই লাইমলাইটে নিয়া আসা হয় নাই। যেমন কালভেদে বাঙালীর জনপ্রিয় আর্টিস্টদের মধ্যে অবনীন্দনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, জয়নুল আবেদিন প্রমুখের নাম বাংলার চিত্রকলা ইতিহাসে নানান গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়, পুস্তকে, প্রবন্ধে ও সাহিত্যে উদ্ধৃতি পেয়ে থাকেন। জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার যে পরিমাণে প্রদর্শনী এই দেশে হয়েছে, তার সিকিভাগও এস এম সুলতানের সময়কালে বা পরবর্তীতে দেখানো হয়নি।

বিদেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সেখানে তার খুব বেশিদিন মন টিকেনি। স্থুল লোভ ও আকর্ষনের ঊর্ধ্বে এসে তিনি তার প্রৌঢ়ত্বে বিদেশী জীবনযাপন বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশে তল্পিতল্পাসহ ফেরত আসেন। জীবনে কখনও বিয়ে করেননি। অতঃপর গ্রামাঞ্চলের এক জমিদারবাড়ি পরিষ্কার করে বসবাস করা শুরু করলেন। শুরু করলেন তার বাংলার কৃষক সমাজ নিয়ে আঁকাআঁকি। সেখানে তিনি গ্রামের শিশুদের আর্ট করাও শিখাইতেন।

চিত্রপটে সুলতানের কৃষক আর জয়নুলের কৃষক একরকম ছিলেন না। জয়নুলের কৃষক ছিলেন অপুষ্টিতে ভোগা, নিপীড়িত এবং অভাবে জর্জরিত কৃষক। সুলতানের কৃষক ছিলেন বলবন্ত যারা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার উম্মাদনা ও ধ্যানে সর্বত ব্রত থাকেন। মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন সুলতানের কৃষকদের দেখলে মনে হবে তাদের সাথে অদৃশ্যমান পাখা লাগানো আছে, যেকোনো মুহুর্তে তারা উড়াল দিতে পারে।

এস এম সুলতানকে নিয়া একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম নির্মাতা তারেক মাসুদ। সিনেমার নাম ‘আদম সুরত’। এর পরে তাকে নিয়ে খুব বেশী মাতামাতি আর হয় নাই। চৌকস বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও চিত্রকরেরা এই মহান চিত্রশিল্পীকে খুব একটা বেশি আলোকপাত করতে উৎসাহী ছিলেন না। এই ধরণের মনোভাবকে বিদেশে একটা সুন্দর টার্ম দিয়েছে যার নাম ‘দ্যা কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স’। যেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে একদল স্বার্থ উদ্ধারকারীরা অবহেলায় ফেলে রাখেন। যাকে খুব বেশি একটা প্রচারগণ্য বলে বিবেচনায় আনা হয় না। তারা তাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না এবং জনসম্মুখে তাকে নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। তাদের বিশেষ নির্মাণ শৈলীকে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে আটকে রাখতে চান। অনেকটা বর্তমান ডিজিটাল সমাজের ফেইসবুকিও লাইক কমেন্টের মতোই। অনেক ভুয়া টাইপের কন্টেন্ট যেমন জনপ্রিয় হইয়া যায়। অপরদিকে, গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট মানুষ ঠিকই দেখে বা পড়ে আলোকিত হয় কিন্তু নিশ্চুপে লাইক কমেন্ট না দিয়া পালাইয়া যায় যেন ফেইসবুকিও এলগরিদম বুঝতে না পারে যে, ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট।

এইজন্য অবশ্য এখন বুদ্ধিজীবীদের একটু কৌশলে কাজ করতে হবে; যেমন তারা তাদের পোস্ট বুস্ট করে সাধারণ জনগনের কাছে পৌছাইতে পারে। এইরকম পরিকল্পনা যে কেউ করতেছে না ব্যাপারটা ঠিক এমনও না। যেমন, সাংবাদিক ও কবি ব্রাত্য রাইসু। তার একটি পডকাস্টে তিনি আরেকজন লেখককে এই বুদ্ধি দিতে শুনেছিলাম। শুনে খুব খারাপ লাগল, চিন্তাবিদদের কথাবার্তা মানুষের কাছে পৌছানো যাচ্ছে না। তবে রাইসু একজন স্মার্ট বুদ্ধিজীবী আমাদের দেশে।

তো সুলতানে আবার ফেরত আসি। বাঙালির সক্রেটিস ও জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তার সন্ধান ঠিকই পেয়েছিলেন। তিনি তাকে বাসায় এনে কয়েক মাস রেখেছিলেন। তাকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্যও করছিলেন। মূলত আহমদ ছফাই আব্দুর রাজ্জাকের সাথে এস এম সুলতানের পরিচয় করিয়ে দিছিলেন। পরবর্তীতে দেখা গেছে আহমদ ছফা বাসায় আসলেন আর সুলতান ও আব্দুর রাজ্জাক বিশেষ আলোচনায় ডুবে আছেন। এই নিয়া আহমদ ছফা কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন, কারণ তিনিই পরিচয় করিয়ে দিছিলেন আর এখন তাকে রেখেই কিনা গুরুগম্ভীর আলোচনা করা হচ্ছে, বিভিন্ন যায়গা যাওয়া হচ্ছে এবং ইত্যাদি। এই গল্প ‘যদ্যপি আমার গুরু’ প্রবন্ধে ছফা মূলত সুলতানকে মহিমান্বিত করার জন্যই লেখে গেছিলেন।

খুবই আনন্দিত হয়েছি যে, সম্প্রতি জানতে পারলাম নুরুল আলম আতিক এই মহান চিত্রশিল্পীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। তার এই সিনেমাতে সোহ্‌রাওয়ার্দী, আহমদ ছফা, আব্দুর রাজ্জাক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকবেন কিনা তা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *