বিশেষ প্রতিবেদক : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ঘটে গেছে নজিরবিহীন হট্টগোল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির বেঞ্চে বৃহস্পতিবার সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জামিন শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় এ নিয়ে দিনভর আদালতের ভেতরে-বাইরে ঘটেছে নানা ঘটনা। আইনজীবীদের হট্টগোল, স্লোগান, নিরুপায় বিচারপতিদের উষ্মা প্রকাশ কিংবা এজলাস ছেড়ে যাওয়া- নানা ঘটনায় পরিস্থিতি ছিল উত্তুঙ্গ। এরপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা এজলাসের বাইরে এসে করেছেন পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন, প্রতিবাদ সমাবেশ।
আদালত কক্ষে বিএনপির আইনজীবীদের হট্টগোলকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা দরকার।
তবে বিএনপির চেয়ারপারসনের জামিন শুনানি না হওয়াকে সরকারের হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিচার চলাকালীন মামলা ও বিবাদীর বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননা করেছেন।
বুধবার গণভবনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কারাবন্দি খালেদা জিয়া হাসপাতালে রাজার হালে আছেন। তিনি যে রোগে আক্রান্ত তা তার আগে থেকেই ছিল। তার সেবার জন্য সব নিয়ম-কানুন ভেঙে একজন নারী তার সঙ্গে থাকছেন।
খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার আদালতে তার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রপক্ষের। কিন্তু তা না পাওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনে শুনানি পিছিয়ে ১২ ডিসেম্বর নির্ধারণ করেন আদালত। এ নিয়ে বিএনপির আইনজীবীরা আদালতে ব্যাপক হইচই করেন।
এ ঘটনাকে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালত অবমাননা বলে মন্তব্য করেন। আদালতে হট্টেগোলের প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ আয়োজিত সমাবেশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বৃহস্পতিবার বিএনপির আইনজীবীরা আদালতে যা করল তা আমার জীবনে কখনো দেখিনি। এটি আদালত অবমাননার শামিল।
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আদালতে বিএনপির আইনজীবীদের আচরণকে বিশৃঙ্খলা বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন শুনানিতে আপিল বিভাগে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আদালতের ওই ঘটনায় সমুচিত জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন।
শুনানি নিয়ে যা ঘটল এজলাসে : বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আদালত পাড়ায় ছিল টান টান উত্তেজনা। এদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে আপিল বিভাগে প্রবেশ করেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীসহ সংবাদকর্মীরা। সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে দেহতল্লাশি করা হয় অনেকেরই। আদালতের মূল গেট, বার কাউন্সিল গেট, মাজার গেটে দেহতল্লাশি করা হয় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীসহ সবাইকে।
প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়ে আপিল বিভাগের এজলাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় সাংবাদিকদের। সকাল নয়টায় আপিল বিভাগের মামলা পরিচালনা শুরু হয়। বৃহস্পতিবারের তালিকায় ৭ নম্বর আইটেমে ছিল খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি। সকাল পৌনে ১০টার দিকে শুনানি শুরু হয়।
শুনানির শুরুতেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে জানান, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যবিষয়ক রিপোর্ট তৈরি হয়নি। আরও কয়েক দিন সময় প্রয়োজন।
এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। তার আগে জামিনের ব্যবস্থা করুন। এমন অবস্থায় আপিল বিভাগ মেডিকেল রিপোর্ট দাখিলের জন্য ১১ ডিসেম্বর এবং পরবর্তী শুনানির জন্য ১২ ডিসেম্বর দিন নির্ধারণ করেন। এই আদেশের পরেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা হট্টগোল শুরু করেন। একপর্যায়ে এজলাসের কক্ষ ত্যাগ করেন বিচারপতিরা।
চা-বিরতির পর বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে পুনরায় আপিল বেঞ্চের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধান বিচারপতি এজলাসে আসা মাত্র খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন দাঁড়িয়ে যান। কিছু বলতে চান। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন কিছু শুনব না।
শুরু হয় আইনজীবীদের হট্টগোল। প্রধান বিচারপতি বলেন, বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। আজকে যা হলো তা আগে দেখিনি।
এ পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি অকর্ষণ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন খালেদা জিয়া রাজার হালে আছেন। তাকে আদালতে উপস্থিত করে দেখেন তার শরীরের অবস্থা।
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা কারও কথা শুনে বিচার করব না। কাগজ দেখে বিচার করব। জয়নুল আবেদীনকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি কোর্ট থেকে বেইল নিয়েছেন। এখন আবার কোর্টে এসে শক্তি দেখাচ্ছেন। আমরা এটা নিয়ে কোনো কিছু করব না। আমরা অন্য আইটেম দেখব। অর্ডার হ্যাজ বিন পাসট।
এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার মইনুল ইসলাম ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলেন, এক মিনিট মাই লর্ড। অর্ডার রিভিউ করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা সবাই চাইলে রোববার।
খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সরকার বললেই হবে না। আমাদের কথা শুনতে হবে।
তখন আবারও আইনজীবীদের হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় অন্য মামলা শুনানির জন্য ডাকা হয়। ডাকে সাড়া দিয়ে ১১টা ৪৪ মিনিটে ডায়াসে আসেন আজমালুল হোসেন কিউসি।
তার পিছনেই ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আব্দুল মতিন খসরু, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে। এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আদালত থেকে বের হতে চাইলে বিএনপিপন্থী অন্য আইনজীবীরা তাকে বাধা দেন। এভাবে চলে ১২টা ৪ মিনিট পর্যন্ত।
এরপর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা এজলাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস (আমরা ন্যায়বিচার চাই)।’ এ সময় বিচারপতিরা এজলাসে চুপ করে বসে ছিলেন। দুপুর সোয়া একটা পর্যন্ত এজলাসের ডান পাশে দাঁড়িয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলতে থাকেন- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ ১টা ১৫ মিনিটে আদালতের এজলাস থেকে নেমে যান বিচারপতিরা।
হতাশ বিএনপির নেতাকর্মীরা
খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার জামিন পেতে পারেন বলে আশায় ছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। কিন্তু শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় হতাশ খালেদার আইনজীবী ও দলটির নেতাকর্মীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিবের দাবি, জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন গত রাতেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সরকারের চাপের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা আদলতে জমা দেয়নি। আপিল বিভাগে খালেদার আপিল শুনানি সাত দিন পিছিয়ে দেওয়ায় সমগ্র জাতি শুধু হতাশার পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।
গত ২৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেন। আদালতে ওই দিন খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, মওদুদ আহমদ ও জয়নুল আবেদীন। দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
গত ১৪ নভেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় জামিন চেয়ে আপিল আবেদনটি করা হয়।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদ-ের রায়ের পর থেকে কারাগারে বন্দি রয়েছেন খালেদা জিয়া। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে হাইকোর্ট সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে। পরে ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়া জামিন আবেদন করেন। সেই আবেদন এখনো আদালতে উপস্থাপন করেননি তার আইনজীবীরা।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের সাত নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি) জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদ- দেন। একই সঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেয়া হয়। একই সাজা হয়েছে মামলার অপর তিন আসামিরও।
খালেদা জিয়ার পাশাপাশি দ-প্রাপ্ত অপর তিন আসামি হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সদ্যপ্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
গত ৩০ এপ্রিল জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের দ-ের বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অর্থদ- স্থগিত এবং সম্পত্তি জব্দ করার ওপর স্থিতাবস্থা দিয়ে দুই মাসের মধ্যে ওই মামলার নথি তলব করেন।
এরপর ২০ জুন বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ৩১ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হলে দুদকের পক্ষে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা করা হয়।