কৃষিতে সরকারের ঈর্ষণীয় সাফল্য

Uncategorized অর্থনীতি জাতীয় বানিজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  ঘরবাড়ি তৈরি ও নগরায়নের কারণে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত কৃষিজমি কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্যশস্য উৎপাদন নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও কৃষিতে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের ঝুঁকির কথা বলা হলেও কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকও বলেছে, বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি হয়নি। ফলে সুবিধাজনক অবস্থায়ই ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বছরে পা রেখেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।


বিজ্ঞাপন

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৯৭১-৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ; এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ। প্রতিবছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখেরও বেশি। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের; বরং তা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখনো কৃষি। বিশ্বে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে থাকলেও বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে।


বিজ্ঞাপন

২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। আর চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে দেশটি। এ ছাড়া ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে সপ্তম স্থানে রয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ।

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আম উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য ছাড়াও মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে মাছ রপ্তানিও বাড়ছে। আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত।

জিডিপিতে কৃষির অবদান :  স্বাধীনতার পর দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে এ হার ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৫৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, বর্তমানে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এলেও মোট অবদান বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ। বাংলাদেশে কৃষি জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত। গত দুই বছরে করোনার প্রকোপে যখন জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে ধস নেমেছিল, তখন কৃষি খাতই দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে পেরেছিল।

কৃষিতে প্রযুক্তি : একসময় লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদই ছিল চাষাবাদের মূল উপকরণ। কিন্তু সেই জায়গা এখন দখল করেছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন্ড হার্ভেপার, ব্রডকাস্ট সিডার পাওয়ার রিপার মেশিন। এমনকি ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষ, বীজ বপন, নিড়ানি, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ফসল ঝাড়া ও প্যাকেটিং পর্যন্ত—সবকিছুই করা হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে, কমছে উৎপাদন ব্যয়। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফসলের অপচয়ও কম হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির ৯০-৯২ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যদি চাষাবাদের সব পর্যায়ে অর্থাৎ জমি তৈরি থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, তাহলে রীতিমতো বিপ্লব ঘটবে কৃষিতে।

কৃষিবিদ ফজলুল হক বলেন, কৃষি যন্ত্রসামগ্রী নির্মাণ দেশের অর্থনীতি এবং কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই খাতটি এখনো ভারী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক বা প্রস্তুত শিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এখন কৃষিকাজ করে। এ হার ২০৩০ সালে ২০ শতাংশে নামবে। আগামী দিনে দেশে হারভেস্টর, ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মতো কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে।

তরুণরা আসছেন কৃষিতে : প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রায়ই হাঁস-মুরগি পালন, গরুর খামার বা মাছের খামার করে ভাগ্য বদলে যাওয়ার গল্প শোনা যাচ্ছে। এসব বাংলাদেশে এখন আর নতুন কোনো ঘটনা নয়। কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষক ও খামারি পর্যায়ে চালু হয়েছে নতুন মেরুকরণে হেঁটে চলার গল্প। একসময় গ্রামাঞ্চলে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনই ছিল কৃষকের বাড়তি আয়ের উৎস। কিন্তু কালের পালাবদলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষিত বেকার যুবক ও নারীরা হাঁস, মুরগির বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বিকল্প প্রজাতির পাখির খামার। এদের মধ্যে টার্কি, তিতির, উটপাখির খামার উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে গরু, ছাগল পালনের পাশাপাশি বিকল্প পশুর খামারে ঝুঁকছেন শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের কৃষি খামারে যুক্ত হয়েছে হরিণ, কুমির, সাপ, উটের মতো বৈচিত্র্যময় পশু। ফল ও সবজি চাষেও তরুণরা দেশের কৃষির চিত্র পাল্টে দিচ্ছেন। আম, বিদেশি ফল ও সবজি চাষে তারা সূচনা করেছেন নতুন দিগন্তের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ। এখন কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ। এখন যারা কৃষিকাজ করেন, তাদের ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষিত বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান। তার মতে, আর কৃষি বলতে ধান চাষ বা পাট চাষ বোঝায় না, এর গন্ডি অনেক বড়। শিক্ষত তরুণরা কৃষিতে আসায় এই খাতটা নতুন রূপ পাচ্ছে। কারণ, নানা সূত্র থেকে তারা কৃষি বিষয়ক তথ্য জোগাড় করতে পারে। তার কাছে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কৃষির খবর আছে। সে সহজেই নতুন কিছু গ্রহণ এবং প্রচলন করতে পারে।

আউশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা : আউশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০-১১ আউশ মৌসুমে ৫১টি জেলার ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৭ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ১ বিঘা করে আউশ ধান আবাদের জন্য বিনা মূল্যে রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। খরিফ-১/২০১২ মৌসুমে ৩০টি জেলার ৫৬ হাজার ২৫০ জন কৃষককে নেরিকা আউশ ও উফশী আউশ ধান চাষের জন্য ৫৬টি জেলার ৩ লাখ ৮ হাজার ৯৫৬ জন কৃষককে চাষাবাদে প্রত্যেককে ১ বিঘা জমি আবাদের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। খরিফ-১/২০১৩ মৌসুমে প্রণোদনা হিসেবে বোনা আউশ (নেরিকা) আবাদে ১৮টি জেলার ৭,০০০ জন ও উফশী আউশ ধান চাষাবাদে ৪৭টি জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে জমি আবাদের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়। এ কর্মসূচিতে সেচ ও আগাছা দমনে কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৪টি জেলার ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে উফশী জাতের আউশ ধান ও ৩৭টি জেলার ১০ হাজার জন কৃষককে ১ বিঘা করে নেরিকা জাতের আউশ আবাদের জন্য বিনা মূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়। খরিফ-১/২০১৫-১৬ মৌসুমে উফশী আউশ ধান ও বোনা আউশ ধান (নেরিকা) চাষে প্রণোদনার লক্ষ্যে উফশী আউশ ধান চাষাবাদে ৪৮টি জেলার ১ লাখ ৮০ হাজার জন কৃষককে ১ বিঘা করে মোট ১ লাখ ৮০ হাজার বিঘা উফশী আউশ ধান ও বোনা আউশ (নেরিকা) আবাদে ৩৭টি জেলার ৩০ হাজার জন কৃষককে ১ বিঘা করে মোট ৩০,০০০ বিঘা বোনা আউশ (নেরিকা) ধান আবাদের জন্য সর্বমোট ২ লাখ ১০ হাজার জন কৃষককে বিনা মূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। এ কর্মসূচিতে সেচ ও আগাছা দমনে কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করা হয়।

কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ ও কৃষকের ব্যাংক হিসাব : কৃষকদের মাঝে কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কৃষক পরিবারকে ২ কোটি ৫ লাখ ৮২ হাজার ৮২৪টি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে কৃষাণীদের ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৭ টি এবং কৃষকদের ১ কোটি ৯৩ লাখ ২৪ হাজার ১৭৭টি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করা হয়। ফসল উৎপাদনে ঋণ, উপকরণ সহায়তা প্রাপ্তিতে কৃষকরা এই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন ও ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কার্যক্রম চালু রেখে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

হাওরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত বোরো চাষিদের সহায়তা কর্মসূচি : বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছরে হাওরাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩ লাখ ৮৫ হাজার কৃষককে রবি/২০১০-১১ মৌসুমে উফশী বা আধুনিক জাতের বোরো ফসল চাষাবাদে সহায়তার জন্য বিনা মূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়। এ কার্যক্রমে ৪৮৪৯.০৮ লাখ টাকার সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, কৃষি উন্নয়নে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য এবং সেচ কাজে পানির অপচয় হ্রাস, ভূগর্ভের পানির সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ের একাধিক কৃষকও এই সুফলের বার্তা দিয়েছেন। একই সঙ্গে কৃষিসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সরকারের ধারাবাহিকতা আর সেই সঙ্গে নানা পদক্ষেপের কারণে উন্নয়নের সুফল মিলছে। কৃষকরাও ফলন ভালো পাচ্ছে। কৃষকরা এখন সারাবছর চাষাবাদ করতে পারছেন। কৃষকরাও মনে করেন তাদের ফলন আগের চেয়ে বেড়েছে নানা পদ্ধতি অবলম্বনের কারণেই। সেই সঙ্গে একই জমিতে একাধিক ফসলও এখন উৎপাদন করার সাহস তারা দেখায় হাতের কাছেই নানা পরামর্শ মিলছে বলেই। সাফল্যের ধারাবাহিকতার আশা প্রান্তিক কৃষকদের।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড.আবদুর রাজ্জাক বলেন, সরকার কৃষিবান্ধব বলেই কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ পদক্ষেপে কৃষিতে উন্নয়ন এসেছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষির একটি নিজস্বতা তৈরি হয়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *