আজকের দেশ ডেস্ক : আমরা প্রায়ই শুনি বাড়িতে একটি করে নিম গাছ লাগান কিন্তু কেন! এর এমন কী উপকারী গুণাগুণ রয়েছে যা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না! কী গুণ আছে এই নিম গাছের ও পাতার, জেনে নিন এখনই।
নিম একটি ঔষধি গাছ যার ডাল, পাতা, রস, সবই কাজে লাগে। নিম গাছের এমন কোন অংশ নেই যার উপকারিতা নেই। কথায় বলে একটি বাড়িতে নিম থাকলে রোগ বালাই দূরে থাকে, বাড়িতে নিম গাছ একজন ডাক্তারের মতই কাজ করে। এমনকি নিম গাছ থাকলে পোকা-মাকড়ও সে বাড়িতে কম দেখা যায়। এর উপকারিকা, গুণাগুণ সম্পর্কে আসুন জেনে নেই।
প্রথমে জেনে নেই এর উৎপত্তি, দ্বিপদী নামকরণ :
নিম যার বৈজ্ঞানিক নাম Azadirachta indica, যা ইংরেজিতে Margosa বা Neem Tree, আরবিতে Neeb নামে পরিচিত। মূলত নিম (Neem) শব্দটি হিন্দী বা নেপালীয়, যা সংস্কৃত নিম্বা (Nimba) বা নিম্বাকা (Nimbaka) শব্দ থেকে এসেছে।
নিমের উৎপত্তি মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় ভারত এবং ভারতীয় উপমহাদেশ (নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা), দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম আফ্রিকাতে।
বাংলাদেশের প্রায় সবত্রই নিম গাছ জন্মে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। নিম একটি বহু বর্ষজীবি ও চির হরিৎ বৃক্ষ। আকৃতিতে ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এর কান্ড ২০-৩০ ইঞ্চি ব্যাস হতে পারে। ডালের চারদিকে ১০-১২ ইঞ্চি যৌগিক পত্র জন্মে। পাতা কাস্তের মত বাকানো থাকে এবং পাতায় ১০-১৭ টি করে কিনারা খাঁজকাটা পত্রক থাকে। পাতা ২.৫-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। নিম গাছে এক ধরনের ফল হয়। আঙুরের মতো দেখতে এ ফলের একটিই বিচি থাকে। সাধারণত জুন-জুলাইতে ফল পাকে, ফল তেতো স্বাদের।
আসুন এবার জেনে নেয়া যাক এর বহুবিধ উপকারিতা, ঔষধি গুণাগুণ এবং ব্যবহারবিধি সম্পর্কে এবং নিমের ঔষধি গুণাগুণ ;
বিশ্বব্যাপী নিম গাছ, গাছের পাতা, শিকড়, নিম ফল ও বাকল ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বে নিমের কদর কিন্তু এর অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহারের জন্য। নিম ছত্রাকনাশক হিসেবে, ব্যাকটেরিয়া রোধক হিসেবে, ভাইরাসরোধক হিসেবে, কীট-পতঙ্গ বিনাশে চ্যাগাস রোধ নিয়ন্ত্রণে, ম্যালেরিয়া নিরাময়ে, দন্ত চিকিৎসায় ব্যাথামুক্তি ও জ্বর কমাতে, জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়।
রক্ত পরিস্কারক, চর্মরোগ নাশক, ব্রণ, কৃমি, কুষ্ঠ ও ক্ষত নিবারক, শরীরের জ্বালা পোড়া, এলার্জি এবং মুখের দুর্গন্ধ নাশক, দাঁতের মাড়ি সবল কারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে নিমপাতা। জীবাণু ও সংক্রমণ প্রতিরোধে এই পাতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যেকোনো ধরনের জমাট ময়লা পরিষ্কারে কার্যকর। ত্বকের যত্নে নিমপাতা তুলনাহীন। খুশকি সারাতে সহায়তা করে এই পাতা। মুখের যত্নেও নিমপাতা অনন্য। এই পাতা খাবারে ব্যবহার করলে রক্ত পরিষ্কার হয়। রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার ভারসাম্য ঠিক রাখে।
এখন আসুন এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক : খোসপাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতঃ নিম পাতা সিদ্ধ করে পানি দিয়ে গোসল করলে খোসপাঁচড়া চলে যায়।এছাড়া খোসপাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতে পাতা (কাঁচা ) প্রয়োজনমত কাঁচা হলুদ মিশিয়ে ভালভাবে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিতে হবে ৭-১০ দিন। নিম পাতা ঘিয়ে ভেজে সেই ঘি ক্ষতে লাগালে ক্ষত অতি সত্বর আরোগ্য হয়।কৃমি নিরসনেঃ পেটে কৃমি হলে শিশুরা রোগা হয়ে যায়। পেটে বড় হয়। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কৃমি নিয়ন্ত্রণে নিমের জুড়ি নেই। ব্যবহারবিধি – এ জন্য ৫০ মিলিগ্রাম পরিমাণ নিম গাছের মূলের ছালের গুঁড়া দিনে ৩ বার সামান্য পানি গরমসহ খেতে হবে। হাম বা চিকেন পক্সঃ হাম বা চিকেন পক্স হলে নিমের পাতাওয়ালা ডাল গায়ে বোলান৷ আরাম পাবেন৷ মরবে সুপারইমপোজড ব্যাকটেরিয়াও ম্যালেরিয়াঃ গ্যাডোনিন উপাদান সমৃদ্ধ নিম ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও নিমপাতা সিদ্ধ পানি ঠাণ্ডা করে স্প্রে বোতলে রাখুন। প্রতিদিন ঘরে স্প্রে করলে মশার উপদ্রব কমে যাবে।
কফজনিত বুকের ব্যথাঃ অনেক সময় বুকে কফ জমে বুক ব্যথা করে। আর এর নিরাময়ে নিমের গুরুত্বও বেশি।
ব্যবহারবিধি – এ জন্য ৩০ ফোটা নিম পাতার রস সামান্য গরম পানিতে মিশিয়ে দিনে ৩/৪ বার খেলে বুকের ব্যথা কমবে। তবে গর্ভবতী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ ঔষধটি নিষেধ।
চোখঃ চোখে চুলকানি হলে নিমপাতা পানিতে দশ মিনিট সিদ্ধ করে ঠাণ্ডা করে নিন। চোখে সেই পানির ঝাপটা দিন। আরামবোধ করবেন।
প্রসাবের জ্বালাপোড়াঃ তিন থেকে চারটি নিম পাতা ও এক গ্রাম কাঁচা হলুদ এক সঙ্গে বেটে খালি পেটে খেলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া থাকে না।
ব্রণের সমস্যাঃ মুখে ব্রণের সমস্যা থাকলে নিম পাতা বেঁটে ব্রণে লাগিয়ে দিন। জাদুর মতো কাজ হবে।
চুলের খুশকি দূরীকরণেঃ চুলের খুশকি দূর করতে শ্যাম্পু করার সময় নিমপাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে চুল ম্যাসাজ করে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। খুশকি দূর হয়ে যাবে।
উকুন নাশক ; নিমের পাতা বেটে হালকা করে মাথায় লাগান। ঘন্টা খানেক ধরে মাথা ধুয়ে ফেলুন। ২/৩ দিন এভাবে লাগালে উকুন মরে যাবে।
জন্ডিস নিয়ন্ত্রণে ; জন্ডিস হলে এক চামচ রসের সাথে একটু মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খান। পুরোপুরি নিরাময় হতে এক সপ্তাহ চালিয়ে যেতে হবে।
বমিঃ বমি আসতে থাকলে নিম পাতার রস ৫-৬ ফোঁটা দুধ দিয়ে খেলে উপশম হয়।
পোকা-মাকড়ের কামড়ঃ পোকা মাকড় কামল দিলে বা হুল ফোটালে নিমের মূলের ছাল বা পাতা বেটে ক্ষত স্থানে লাগালে ব্যথা উপশম হবে।
রাতকানাঃ রাতকানা রোগে নিমের ফুল ভেজে খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেঃ ১০টি নিম পাতা ও ৫টি গোল মরিচ একসাথে সকালে খালি পেটে খেয়ে ফেলুন। ডায়াবেটিস দৌড়ে পালাবে।
দাঁতের রোগঃ নিমের পাতা ও ছালের গুঁড়ো কিংবা নিমের ডাল দিয়ে নিয়মিত দাঁত মাঁজলে দাঁত হবে মজবুত এবং দাঁতের রোগ হতে রক্ষা পাবে।
অ্যালার্জির সমস্যায়ঃ অ্যালার্জির সমস্যায় নিম পাতা ফুটিয়ে গোসল করুন। অ্যালার্জি যাবে ১০০ হাত দূরে। তাছাড়া কাঁচা হলুদ ও নিম পাতা একসাথে বেঁটে শরীরে লাগান।
জন্ম নিয়ন্ত্রণেঃ নিমের তেল একটি শক্তিশালী শ্রুক্রানুনাশক হিসেবে কাজ করে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, নিমের তেল মহিলাদের জন্য নতুন ধরনের কার্যকরী গর্ভনিরোধক হতে পারে। এটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই শুক্রানু মেরে ফেলতে সক্ষম।
অজীর্ণঃ অনেকদিন ধরে পেটে অসুখ। তেমন উপকারও পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে নিম উপকারে আসতে পারে।
ব্যবহারবিধি – পাতলা পায়খানা হলে ৩০ ফোটা নিম পাতার রস, সিকি কাপ পানির সঙ্গে মিশিয়ে সকাল- বিকাল খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে।
এছাড়া নিমের পাতা বিছানায়, জামাকাপড়ে রাখুন৷ পোকামাকড় ও ছত্রাক মরবে৷ এ কাঠে কখনো ঘুণ ধরে না। পোকা বাসা বাঁধে না। উইপোকা খেতে পারে না। এ কারণে নিম কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি করা হচ্ছে আজকাল। নিমের গুনাগুনের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিম গাছকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষনা করেছে।
এতক্ষণ এর উপকারিকা গুণাগুণ সম্পর্কে অনেক কিছুই বললাম। এর আরেকটি কেরামতি হচ্ছে আপনি চাইলেই নিম পাতা দিয়ে চা করতে পারেন। আসুন জেনে নেই কিভাবে চা তৈরী করবেন।
শুকনো নিম পাতা গুঁড়ো অথবা তাজা নিমের ৬/৭ টি পাতা গরম পানিতে ছেড়ে ২/৩ মিনিট জ্বাল দিবেন। তারপর মধু মিশ্রিত করলেই হয়ে যাবে সুমিষ্ট নিম চা। তবে নতুনদের জন্য জ্বাল দেওয়ার সময়সীমা ১ মিনিট। কারণ যত বেশি জ্বাল দিবেন, তত বেশি তেতো হবে।
কখন রোপন করতে হবে বা কখন নিম গাছ লাগাবেনঃ জুন মাস থেকেই নিম গাছের বীজ রোপন করা যায়। আর বর্ষাকালই এর উপযুক্ত সময়। তবে চারার ক্ষেত্রে নিম গাছ বৃষ্টির সময়ে অথবা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে চারা লাগানো ভালো। এখন বর্ষাকাল চলছে, সুতরাং এখনই উপযুক্ত সময় চারা লাগানোর।
তাহলে এখন হয়তো বুঝে গিয়েছেন বাড়িতে নিম গাছ লাগানো কেন এত দরকারি! সুতরাং আর দেরি না করে দ্রুত আপনার বাড়িতে বা বাসার ছাদে অন্তত একটি করে নিম গাছ লাগাবেন। আশাকরি এ ভেষজ বৃক্ষ আপনাকে নিরাশ করবে না।