বিনোদন প্রতিবেদক : এদেশের চলচ্চিত্রে হৃদয় হরণ করা গ্ল্যামার আর নিপুণ অভিনয় প্রতিভা নিয়ে যেন আলো ছড়াতে এসেছিলেন একজন চিত্রনায়িকা। দেশীয় চলচ্চিত্রে ওয়েস্টার্ন ড্রেসে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গ্ল্যামারাস সেই চিত্রনায়িকাকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন এদেশের আপামর দর্শক মহল। যার কথা লিখছি, তিনি নব্বই দশকে রূপালি পর্দার দর্শকপ্রিয় এবং ওই প্রজন্মের প্রবল সম্ভাবনাময় চিত্রনায়িকা তামান্না হাসিন হুদা; চলচ্চিত্রে যিনি তামান্না নামেই সর্বাধিক পরিচিত। কীভাবে চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়ায় আবির্ভাব ঘটল এই চিত্রনায়িকার তা জানতে আমাদের ফিরতে হবে তার শৈশবে। তার জন্মস্থান বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা জেলায়, পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায় এবং মাতৃ নিবাস মুন্সিগঞ্জে। শৈশবে পরিবার নিয়ে সুইডেনে থাকতেন তামান্না। তখন তিনি সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, নাড়ীর টানে একবার দেশে বেড়াতে এলে আফজাল হোসেনের নির্মাণে ‘স্টারশিপ কন্ডেন্সড মিল্ক’ এর মডেল হন তিনি। সালটা তখন ১৯৯৫। আর এভাবেই শুরু হয় তার অভিনয় জীবন। নজরকাড়া চেহারার লাবণ্যে সিনেমার পরিচালকরদেরও চোখ এড়িয়ে যাননি তামান্না।
নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক সাইফুল আজম কাশেম পরিচালিত ‘ত্যাজ্যপুত্র’ সিনেমায় কাজ করার মাধ্যমে প্রথমবার সিনেমার ঝলমলে পর্দার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে এই চিত্রনায়িকার; যদিও তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ‘ভণ্ড’। ‘ত্যাজ্যপুত্র’ সিনেমাটিতে তার বিপরীতে পেয়ে যান বাপ্পারাজের মতো জনপ্রিয় চিত্রনায়ককে। এছাড়াও সিনেমাটিতে ওমর সানী, মৌসুমী ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন অনেকেই। তবে তিনি সবথেকে বেশি আলোচিত হন আরেকজন বরেণ্য পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘ভণ্ড’ সিনেমার মাধ্যমে। সিনেমাটিতে তামান্নার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ‘মার্শাল আর্ট’ খ্যাত ওই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মাসুম পারভেজ রুবেল। উল্লেখ্য, বহুল আলোচিত ‘ভণ্ড’ সিনেমাটি মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই শহীদুল ইসলাম খোকনের চারটি সিনেমায় এক দিনেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তামান্না। তবে ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার দরুণ সিনেমাগুলো ছেড়ে দিতে হয় তাকে। এই ঘটনায় পরিচালক অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন এবং অনেকবার তার কাছে সিনেমাগুলো ছেড়ে দেয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল তখন। তাই সিনেমাগুলো থেকে সরে আসার কারণ বলতে পারেননি তামান্না।
স্বল্প ক্যারিয়ারে বেশ কিছু দর্শকনন্দিত সিনেমা উপহার দিয়েছেন তামান্না এবং অভিনয় করেছেন ঢালিউডের আজকের সুপারস্টার শাকিব খান সহ বাপ্পারাজ, রুবেল, রিয়াজ, শাকিল খান, মান্নার মতো জনপ্রিয় চিত্রনায়কদের সঙ্গে। তামান্না অভিনীত উল্লেযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ভণ্ড’, ‘ত্যাজ্যপুত্র’, ‘হৃদয়ে লেখা নাম’, ‘তুমি আমার ভালোবাসা’, ‘অশান্তির আগুন’, ‘কঠিন শাস্তি’, ‘মুখোশধারী’, ‘আমার প্রতিজ্ঞা’, ‘চাই শুধু ভালোবাসা’, ‘সন্ত্রাসী বন্ধু’ এবং সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাগল তোর জন্য রে’।
বর্তমানে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুইডেনেই বসবাস করছেন তামান্না। চলচ্চিত্রে এবং নিজের ক্যারিয়ারে যে আশার বীজ বপন করেছিলেন এই চিত্রনায়িকা, পরবর্তীতে সেই চলচ্চিত্র থেকেই গুটিয়ে নেন নিজেকে। ঢাকাই চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতা যখন সর্বাগ্রে গ্রাস করেছিল, তখনও সেই অশ্লীলতায় নিজেকে সঁপে দেননি তিনি। তাইতো তিনি চলচ্চিত্র থেকে দূরে থাকলেও এখনও রয়ে গেছেন তার অগণিত শুভাকাঙ্খী ও ভক্তের গহীন অন্তস্থলে। তিনি পেশাগত জীবনে Supervisor, Dance Educator, Wellness Educator হিসেবে কাজ করছেন। শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার নারীদের নিয়েও কাজ করার দৃঢ় পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকাই সিনেমার অন্যতম এই চিত্রনায়িকার। এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করা তার বহুদিনের লালিত স্বপ্নও বটে। তার ভাষ্যমতে, অনেক নারী সুইডেনে থেকেও এমন খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যা অনেকেরই কল্পনার বাইরে! সুইডেন এত উন্নত এবং আধুনিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও নারীরা এখানে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, যা সত্যিই অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও দুঃখজনক।
এদিকে জানা যায় যে, ‘অরণ্য আলো’ নামক একটি আশ্রম প্রকল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি৷ তিন বছর ধরে এই প্রকল্পের সঙ্গে রয়েছেন চিত্রনায়িকা তামান্না৷ দেশের বাইরে থাকলেও নিজের দেশের প্রতি যেন এখনও আগের মতোই অকৃত্রিম মায়া ও টান অনুভব করেন গ্ল্যামারাস এই চিত্রনায়িকা। দেশের সমাজকল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে ‘অরণ্য আলো’ আশ্রম প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সমাজের অবহেলিত, দুঃস্থ ও জীবনযুদ্ধে আশাহত ও অভাব-পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতেই মূলত তার এই উদ্যোগ।
সবমিলিয়ে বলা যায়, তামান্না হারিয়ে যাননি। বরঞ্চ তামান্না হুদা বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বিভিন্ন শ্রেণির দর্শক হৃদয়ে এবং এখনও ওতোপ্রোতভাবে মিশে রয়েছেন এদেশের চলচ্চিত্রে তার ভূমিকার জন্য দর্শকদের মাঝে, দর্শকদের সাথে, দর্শকদের পাশেই। প্রবাসে থাকলেও বাংলা সিনেমার সঙ্গেই রয়েছে তার নিগূঢ় আত্মিক সম্বন্ধ৷ গত বছর ‘ঈদুল আজহা’তে মুক্তিপ্রাপ্ত সুপারস্টার শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার ভূয়সী প্রশংসা করতেও তাই ভুল করেননি তিনি। তামান্নার ‘অশান্তির আগুন’, ‘কঠিন শাস্তি’ ও ‘মুখোশাধারী’ তিনটি সিনেমার নায়ক শাকিব খানের সিনেমায় পঞ্চমুখ হয়ে তার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘‘শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার গান, ট্রেলার আর পোস্টার দেখে কোনো সংশয় ছাড়াই আমি বলব, শাকিব খান আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে’’। বাংলা সিনেমার প্রতি এখনও তার ভালোবাসার জায়গাটা অক্ষুণ্ন রয়েছে বলেই হয়তো দূরে থাকলেও বাংলা সিনেমার ইতিবাচক দিকগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন না তিনি।
তামান্না অভিনয় জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন তার যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত হবার পূর্বেই। হয়তোবা ব্যক্তিগত বা নানাবিধ কারণে অভিনয় থেকে তার দূরে সরে যাওয়া। তবে অল্প কাজেই যেন মানুষের কাছে গল্প বনে গিয়েছেন তামান্না আর সর্বোপরি যে একটা বৃহৎ আসন পেতে রেখেছেন মানুষের মন, মনন ও দর্শনে তা নিঃসংচোতেই বলতে পারা যায়।