নিজস্ব প্রতিবেদক : সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ১৬ কেজি স্বর্ণসহ আরব আমিরাত-ফেরত এক যাত্রীকে আটক করেছে গোয়েন্দা সংস্থা ও শুল্ক গোয়েন্দা টিম। এ সময় ১০৫টি স্বর্ণের বার ও চারটি গোলাকৃতির স্বর্ণের টুকরা জব্দ করা হয়। গতকাল বুধবার গ্রিন চ্যানেল পার হয়ে বিমানবন্দরের গাড়ি পার্কিংয়ে ব্যাগ তল্লাশি করে এসব স্বর্ণ জব্দ করা হয়। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
আটক হোসাইন আহমেদ (২৫) সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল বাজার এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বর্ণের চালানটির নেপথ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সোনা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত দিলীপ-দোলন সিন্ডিকেট। এর মধ্যে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। আর এনামুল হক খান ওরফে দোলন অনিয়মের দায়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি।
সূত্র জানিয়েছে, স্বর্ণসহ ধরা পড়া হোসাইন আহমেদ সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের সক্রিয় ক্যারিয়ার বা বাহক। টাকার বিনিময়ে স্বর্ণ পাচারের কাজ করে এই চক্র। প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় কৌশলে তাঁদের মাধ্যমে দেশে সোনা পাচারে সহায়তা করে চক্রটি। সেই প্রবাসী দেশে ফেরার পর সিন্ডিকেট সদস্যদের মাধ্যমে নিরাপদ স্থানে সোনার চালানটি বুঝে নেয় সদস্যরা।
দিলীপ ও দোলন সিন্ডিকেট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে বিভিন্ন কৌশলে বিদেশ থেকে সোনা পাচার করেছে। দিলীপ কুমার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ও দোলন ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের হুন্ডি ব্যবসা ও সোনা চোরাচালানের সহযোগী। ফলে হত্যা, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার মতো ভয়ংকর তথ্য থাকলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে হাজার কোটি টাকা কামিয়েছে এই সিন্ডিকেট।
সূত্র আরো জানায়, দিলীপ কুমার আগারওয়ালাকে সোনা-হীরা চোরাচালান ও বিদেশে অর্থ পাচারের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রমাণসহ ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। তবে দুদকে হাজির হতে দুই মাসের সময় চান দিলীপ।
পরবর্তী সময়ে আবার চিঠি দিয়ে দুবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই সময় দিলীপ কুমারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে দুদকের টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা বিভাগ, বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন স্থানে চিঠি দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের ছত্রচ্ছায়ায় ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর হঠাৎই অভিযোগ নথিভুক্ত (দায়মুক্তি) করে দুদক। দায়মুক্তির ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দুদকের ওই সময়কার মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাইদ মাহবুব খান।
এদিকে দোলনের বিরুদ্ধে সোনা চোরাকারবারের তথ্য দিয়েছে দুবাই ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এনামুল হক খান দোলন দুবাই এবং সিঙ্গাপুর সিন্ডিকেটের সহায়তায় এই দুই জায়গা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার দেশে পাঠান।
বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৫২ ফ্লাইটটি গতকাল বুধবার সকাল ৮টা ২১ মিনিটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী শারজাহ থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তথ্য পেয়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) এবং শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা চ্যালেঞ্জ করেন ওই ফ্লাইটের যাত্রী হোসাইনকে। প্রথম দফায় কাস্টমস স্ক্রিনিং করে হোসাইনের লাগেজে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় না। তবে চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা শাখার সহায়তায় নিরাপত্তা স্ক্রিনিং বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে আবার স্ক্রিনিং করে তাঁর লাগেজে স্বর্ণের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। পরে শনাক্ত মালামাল ভেঙে স্বর্ণের চালান জব্দ করা হয়।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মো. সাজেদুল করিম বলেন, শারজাহ থেকে আসা বিমানের বিজি-২৫২ ফ্লাইটে অভিযান চালিয়ে হোসাইন আহমেদ নামের এক যাত্রীর সঙ্গে থাকা ১৫ কেজি ৯১০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০৫ টি স্বর্ণের বার এবং চারটি গোলাকৃতির স্বর্ণের টুকরা রয়েছে।স্বর্ণের মূল্য সম্পর্কে এ কর্মকর্তা বলেন, এখনো দাম নির্ধারণ করা হয়নি। বাজারদর ওঠানামা করে। তবে এখানে আনুমানিক ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ১২৮ টাকার স্বর্ণ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, ওই যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। এত বড় চালানের সঙ্গে অবশ্যই দেশের শীর্ষস্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সোনা চোরাকারবারিরা জড়িত। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ সোনা জব্দ করা হয়।
ওসমানী বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দরের গ্রিন চ্যানেল পার হয়ে পার্কিংস্থলে চলে গিয়েছিলেন হোসাইন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁর গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় বিমানবন্দরের এভিয়েশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে পুনরায় গ্রিন চ্যানেলে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর দুটি লাগেজ তল্লাশি করে চারটি জুস মেশিনের ভেতর থাকা ১০৫টি স্বর্ণের বার ও স্বর্ণের ছোট চারটি চাকতি জব্দ করা হয়।