কোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্য করে গা-ঢাকা দিয়েছে এলজিইডি’র মশিউল-ফাত্তাহ চক্র

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের গত আট মাসে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) আউটসোর্সিং খাতে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় হাজারখানেক জনবল নিয়োগ দিয়েছে। এই বিশাল নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।


বিজ্ঞাপন

সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ মিয়ার ঘনিষ্ঠজন মশিউল আলম (বিশেষ ক্যাশিয়ার) ও আবু ফাত্তাহ (কথিত মিডিয়া কনসালটেন্ট) এই নিয়োগ বাণিজ্যের মূল হোতা বলে ভুক্তভোগী প্রার্থীরা দাবি করেছেন।

এলজিইডির অধীনে দেড়’শর বেশি উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। প্রতিটি প্রকল্পেই আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের সুযোগ থাকে। চলতি বছরের শুরু থেকে ডজন খানেক নতুন প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। জলবায়ু প্রকল্পে একাই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে ৩৭৫ জন, টুলু প্রকল্পে ৫০ জন এবং বৃহৎ প্রকল্প RUTDP-তে প্রায় ৩০০ জন। ছোট-বড় আরও অনেক প্রকল্পে নিয়োগ চলছে আবার অনেক প্রকল্প শেষও হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

এই নিয়োগ গুলোতে পদভেদে ঘুষের হার নির্ধারণ করে দিয়েছিল মশিউল-ফাত্তাহ চক্র। সহকারী প্রকৌশলী পদে ঘুষ ধরা হয় ৫ লাখ টাকা, উপ-সহকারী প্রকৌশলী ৩ লাখ, কার্য সহকারী ২ লাখ, সুসোলজিস্ট ৩–৪ লাখ এবং অন্যান্য পদে ২ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, এভাবে অন্তত আড়াই শতাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

প্রধান প্রকৌশলী পরিবর্তনের পর এলজিইডি ভবনের আশপাশে প্রতিদিন ভিড় করছে প্রতারিত প্রার্থীরা। অনেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুঁজছেন মশিউল এবং ফাত্তাহকে।

ফরিদপুরের শরিফুল ইসলাম, ডিপ্লোমা সিভিল পাশ, বলেন, “দুই মাস আগে পাশের ভবনের মিডিয়া ইউনিট প্রধান আবু ফাত্তাহর কাছে তিন লাখ টাকা ও সিভি দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ হয়ে গেল, কিন্তু আমাকে ডাকেনি।”

বগুড়ার শিউলি আক্তার, বিএসসি পাশ, জানান, “মশিউল আলমের কাছে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম। আমার সিভিতে সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর ‘ব্যবস্থা নিন’ সিলও আছে। এখন মশিউল ফোন ধরছে না, অফিসেও নেই।”

পাবনার সামসুল আলম বলেন, “দুইটি গরু বিক্রি করে আর সুদে টাকা এনে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম কার্য সহকারী পদে চাকরির জন্য। কিন্তু মশিউল স্যারের ফোন বন্ধ। শুনলাম সে ঢাকাও ছেড়ে দিয়েছে।”

এমনই অভিযোগ শ’খানেক প্রার্থীর। অনেকেই জীবন-সংসার তছনছ করে টাকা দিয়েছেন, কিন্তু চাকরি পাননি।

সূত্র বলছে, মশিউল ও ফাত্তাহ সরাসরি সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রশীদ মিয়ার নাম ব্যবহার করতেন। বলা হতো, “প্রধান প্রকৌশলী আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন।”

সিভি নিয়ে গেলে রশীদ মিয়া বা তার ঘনিষ্ঠরা তাতে ‘ব্যবস্থা নিন’ লিখে দিতেন। এভাবে আস্থা অর্জন করে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেওয়া হতো।

অভিযোগ আছে, জলবায়ু প্রকল্পের ৩৭৫ জন নিয়োগের মধ্যে অন্তত ২৫০ জন সরাসরি রশীদ মিয়ার তালিকা থেকে নিয়োগ পেয়েছেন। গড়ে চার লাখ টাকা করে অন্তত ১০ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। আর ইউ টিডিপি প্রকল্পে রশীদ মিয়া ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি)-র মধ্যে “ফিফটি-ফিফটি” ভাগাভাগির চুক্তিও হয়েছিল।

শুধু সাধারণ প্রার্থী নয়, সাংবাদিকরাও প্রতারিত হয়েছেন। একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানান “রশীদ মিয়া আমার দেওয়া পাঁচটি সিভিতে ‘ব্যবস্থা নিন’ লিখেছেন। বিভিন্ন প্রকল্পে মার্কও করেছেন। কিন্তু কাউকেই ইন্টারভিউতে ডাকেনি।”

মশিউলের পরিচয় : মশিউল আলম মূলত উপ-সহকারী প্রকৌশলী। সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা। প্রথমে আউটসোর্সিংয়ে চাকরি শুরু করে পরে অনিয়ম করে জিওবি ক্যাডারে প্রবেশ করেন। দীর্ঘদিন সিরাজগঞ্জে থেকে সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার দলীয় স্থানীয় এমপিদের ছত্রছায়ায় ঠিকাদারি করেছেন। রশীদ মিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী হয়ে উঠেন এবং তার সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করতেন। বর্তমানে সিরাজগঞ্জে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

আবু ফাত্তাহ’র পরিচয় : আবু ফাত্তাহ ২০১০ সালে কনসালটেন্ট হিসেবে এলজিইডিতে প্রবেশ করেন। এইচএসসি পাশ হলেও ভুয়া বিএ সনদ ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। চাকরিচ্যুত হওয়ার পরও লবিং করে ফের চাকরিতে ঢোকেন। বর্তমানে সৌদি আরবে উমরাহ পালনে আছেন।

এই নিয়োগ বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় অনেকে। সাবেক প্রধান প্রকৌশলী অবসরে যাওয়ার পর নিয়োগ বাণিজ্যের অনেক কাহিনি প্রকাশ্যে এসেছে। প্রতারিত প্রার্থীরা এখনো ন্যায়বিচারের আশায় ঘুরছেন। এলজিইডির সর্ববৃহৎ প্রকল্প RUTDP ও জলবায়ু প্রকল্পে ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণ ইতোমধ্যে হাতে এসেছে বলে দাবি করেছে একাধিক সূত্র।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *