!! নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নেসকোর নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) সৈয়দ গোলাম আহম্মেদসহ ১০ কর্মকর্তাকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে দায়ী অন্যরা হলেন নেসকোর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (কারিগরি ও অপারেশন) এ এইচ এম কামাল, উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ বি এম ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সুবীর রঞ্জন পোদ্দার, সহকারী ব্যবস্থাপক আরিফুর রহমান, ইমদাদুল হক মিয়া, মোছা. মাসুমা আক্তার, মোহাম্মদ আবদুর রহিম, ফয়সাল বিন ওমর ও সজীব কুমার ঘোষ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি!!
নিজস্ব প্রতিবেদক : নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) শীর্ষ ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ, নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিগত সরকারের সময় দুদকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন গোপন করে রেখে তারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে অধস্তন বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দিয়েছেন। সরকার পরিবর্তনের পর পাঁচ বছর আগের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে আলোচনায় আসে বিষয়টি। তদন্ত প্রতিবেদনে নাম না থাকলেও বিষয়টি গোপন রাখায় উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকিউল ইসলামকেও এর জন্য দায়ী করছেন পদবঞ্চিত কর্মকর্তারা। অভিযোগ মতে, বিগত সরকারের এক প্রভাবশালীর আত্মীয় হওয়ায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম রাখা হয়নি।
নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নেসকোর নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) সৈয়দ গোলাম আহম্মেদসহ ১০ কর্মকর্তাকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে দায়ী অন্যরা হলেন নেসকোর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (কারিগরি ও অপারেশন) এ এইচ এম কামাল, উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ বি এম ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সুবীর রঞ্জন পোদ্দার, সহকারী ব্যবস্থাপক আরিফুর রহমান, ইমদাদুল হক মিয়া, মোছা. মাসুমা আক্তার, মোহাম্মদ আবদুর রহিম, ফয়সাল বিন ওমর ও সজীব কুমার ঘোষ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালের ৫ জুলাই নেসকোতে ২০ জন নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগের জন্য ত্রুটিপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে, আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ২০ জন নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়টি তখন দুদকের নজরে আনা হলে দুদকের পক্ষ থেকে পুরো অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়ে নেসকোকে চিঠি দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রধান প্রকৌশলী হযরত আলীকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০১৯ সালের ১০ জুন এই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দুদক, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও নেসকোর কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে ২০ কর্মকর্তা নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চাকরি প্রার্থীদের সাত বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও নিয়োগ পাওয়া ২০ জনের মধ্যে ১২ জনেরই সাত বছরের অভিজ্ঞতা নেই। চাকরির নীতিমালা অনুযায়ী নির্বাহী প্রকৌশলীর চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৪০ বছর উল্লেখ করা থাকলেও গোলাম মোস্তফা নামে একজনের বয়স ৪০ বছরের বেশি ছিল। নেসকোর নিয়োগ কমিটি আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব নিয়োগ দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রাপ্ত আবেদনসমূহ সংগ্রহ করে যোগ্য প্রার্থীর তালিকা প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণসহ যাবতীয় কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ জন্য নিয়োগ কমিটিকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক সহকারী প্রকৌশলী যারা উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পাননি বা পাওয়ার যোগ্য নন, তাদের আবেদন বৈধ হয় এবং তারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একজন সহকারী প্রকৌশলী উপবিভাগীয় প্রকৌশলী না হয়ে কোনোভাবেই সরাসরি নির্বাহী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পেতে পারেন না। কারণ, সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী নির্বাহী প্রকৌশলীর পদটি পঞ্চম গ্রেডের। কিন্তু একজন সহকারী প্রকৌশলী সপ্তম গ্রেডের বা নিচের গ্রেডের।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিযোগ তদন্তকালে নিয়োগ কমিটির অনেক সদস্যই নিজেদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেন। নিয়োগ কমিটির সদস্য নেসকোর সহকারী মহাব্যবস্থাপক আবু মোত্তালেব বলেন, আমি সদস্য ছিলাম তবে নিয়োগের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম না। অন্য সদস্যরা অধিকাংশই তদন্ত কমিটির সামনে নিজেদের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যান। তারা নিয়োগ সংক্রান্ত সব দায়দায়িত্ব নেসকোর এমডি প্রকৌশলী জাকিউল ইসলামের ওপর চাপান। তদন্ত প্রতিবেদনে অসাধু পন্থায় নিয়োগ পাওয়া ২০ নির্বাহী প্রকৌশলীর নিয়োগ বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে ৫ বছরেও তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি নেসকোর পরিচালনা বোর্ড।
২০১৯ সালে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন এতোদিন প্রকাশ না পেলেও সরকার পরিবর্তনের পর সম্প্রতি এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে নেসকোর বঞ্চিত প্রকৌশলীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে ১০ কর্মকর্তাকে দায়ী করে বলা হয়, জাতীয় বেতন গ্রেড অনুযায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী পঞ্চম গ্রেডের পদ। অযোগ্য লোক ভুয়া সনদ দিয়ে এই পদে নিয়োগ পেলে উত্তরবঙ্গের বিদ্যুৎ খাত হুমকির মুখে পড়বে।
নিয়োগ পাওয়া নির্বাহী প্রকৌশলীদের আবেদনপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০ জনের মধ্যে ১৪ জনই অযোগ্য। তাদের একজন ইয়াসির আরাফাতের চাকরির অভিজ্ঞতা ৭ বছরের চেয়ে ১৪ দিন কম। এ ছাড়া তার অন্যত্র বিগত চাকরির এক বছর দুই মাস আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন বা বিতরণকারী কোনো প্রতিষ্ঠানে ছিল না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রের ভাষ্যমতে, তদন্ত কমিটি ১০জনকে দায়ী করলেও এসব দুর্নীতির মূলে আছেন নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম। তিনিই মূলত তদন্ত রিপোর্ট গোপন করেছেন। বিগত সরকারের প্রভাবশালী একজনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় গত ৯ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। এসব নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্যের মূল হোতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি কৌশলে তদন্তকারীদের ম্যানেজ করে তার নাম কাটতে সক্ষম হয়েছেন। নেসকোর নির্বাহী পরিচালকের সাথে যোগসাজসে এসব দুর্নীতি করেছেন এমডি। বিভিন্ন সময়ে ঘুষ গ্রহণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এমডির বিরুদ্ধে। এর আগেও দুদক তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে তদন্ত করেছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, নিয়োগ বাণিজ্যের মত পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বাণিজ্য করেছেন নির্বাহী পরিচালক। যে তদন্ত প্রতিবেদনে ১০জনকে দায়ী করা হয়েছে তার প্রধান নেসকোর নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) সৈয়দ গোলাম আহম্মেদ। অভিযোগে জানা যায়, চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি চার জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠতার রীতি না মেনে তিন নম্বর ও পাঁচ নম্বর সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে তাদের চেয়ে আট বছরের জুনিয়র ৯ নম্বর কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে গত ৮ মে ৩৭ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সহকারী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে ১, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০ সহ অন্যান্যদের না দিয়ে ১০১, ১০২, ৯৮, ৯৫, ৯৪ সহ অধিক জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একাধিক সূত্রের ভাষ্য মতে, আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে নেসকোর টেকনিক্যাল ও নন টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতার রীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সূত্র মতে, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের নেসকোর সব দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। গত ৭ আগস্ট রাজশাহী এবং ২১ আগস্ট রংপুর নেসকোর দপ্তরে গেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখেন সেখানকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পরে দুই জায়গাতেই সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি বের হয়ে আসতে সক্ষম হন।
নেসকোর নিয়োগে অনিয়মের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন বঞ্চিতরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকিউল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, ‘২০ জন নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগের বিষয়ে দুদকের প্রতিবেদন নেসকোর কাছে জমা দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে পিডিবিতে। প্রতিবেদনটি ধামাচাপা দেওয়া হয়নি। এতদিন প্রতিবেদনের বিষয়ে আমি জানতাম না।’ সম্প্রতি প্রতিবেদনটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তিনি সেটি জানতে পারেন বলে স্বীকার করেন। তা ছাড়া দুদকও বিষয়টি তাকে জানায়নি বলে তিনি দাবি করেন। নিয়োগ বাণিজ্য, পদোন্নতিতে টাকা নেওয়াসহ অন্যান্য অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার একার কিছু করার ছিল না। যাচাই বাছাই করে কমিটি নিয়োগ দিয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে কোম্পানিতে নিয়োগ, পদোন্নতি দেওয়া হয়।’
নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে নেসকোর নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) সৈয়দ গোলাম আহম্মেদ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে গণমাধ্যমে বলেন, যাচাই বাছাই করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দুদকের প্রতিবেদন এখনও তাদের কাছে আসেনি। তাছাড়া তিনি দাবি করেন, তিনি শুধু আর্থিক বিষয়টি দেখেন।