সচিবালয়ে কর্মরত বেশিরভাগ পিয়ন যেভাবে বনে যান সচিব !

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক :  বাংলাদেশ সচিবালয়ে অফিস ছুটির পরে পিয়ন হয়ে যায় সচিব, সম্প্রতি এমনই এক অভিযোগ উঠেছে সচিবালয়ে কর্মরত বেশিরভাগ পিয়নের বিরুদ্ধে।


বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘেরা দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে সক্রিয় চাকরিদাতা প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। বহিরাগত দালাল ছাড়াও এ চক্রে জড়িত সচিবালয়েই কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারী। অফিস সময় শেষে যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয় ছাড়েন, তখন তাদেরই কক্ষে শুরু হয় প্রতারকদের ‘অফিস’!

পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে এসব প্রতারকের কেউ বনে যান সচিব-উপসচিব; কেউবা তাদের পিএ। কখনও উপসচিবের কক্ষে, কখনো যুগ্ম সচিবের কক্ষে- কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসেই প্রতারকরা চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার নাটক করে বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছে মাথাপিছু ১০ থেকে ১৮ লাখ টাকা।


বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, সংঘবদ্ধ এ প্রতারকচক্রের সদস্যরা চাতুর্যের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন দপ্তরের প্যাডে সংশ্লিষ্ট উপসচিবের স্বাক্ষর জাল করে প্রকৃত নিয়োগপত্রের মতো হুবহু অথচ ভুয়া নিয়োগপত্র তুলে দিয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে। চাকরির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ‘একমাত্র রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহার্য’ লেখা সরকারি খামে সচিবের নামে তারা ভুয়া নিয়োগপত্র দেয় ভুক্তভোগীদের।


বিজ্ঞাপন

মোটা টাকা গ্রহণ করার পর মাসের পর মাস ঘুরেও যখন চাকরিপ্রত্যাশীরা দপ্তর বুঝে পায় না, তখন গা বাঁচাতে তাদের হাতে ট্রেনিং পিরিয়ডের নামে দু-এক মাসের বেতনও তুলে দেয় চক্রের সদস্যরা। এভাবে চক্রটির খপ্পরে পড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্ধশতাধিক তরুণ-তরুণী সর্বস্ব হারিয়ে ঘুরছেন পথে পথে। এসব বিষয়ে ২০১৯ সালে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় * বিকালে ওরাই সচিব* শিরোনামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

এই চক্রের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলা (নম্বর-১৩) করেন একেএম মোসলেহ উদ্দিন নামে প্রতারণার শিকার একজন। অভিযোগ- অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের (প্রশাসন) স্বাক্ষর জাল করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চেয়ারে বসে, রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার্য খামে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়ার মাধ্যমে দুই চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

মামলায় আসামি করা হয় সচিবালয়ে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. শফিকুল ইসলাম (ফরাশ শাখা- সকালে অফিসের তালা খোলা এবং বিকালে তালাবদ্ধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী), কেএম মোর্তুজা আলী রনি এবং তাদের সহযোগী দালাল মো. শাহিনুল কাদির সুমন ওরফে পালসার সুমনকে। এরপর র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় সচিবালয়ের কর্মচারী শফিকুল ইসলাম ও বহিরাগত দালাল পালসার সুমন। এই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে ৬ বছর। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও শেষ হয়নি বিচারকার্য।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মামলাটি প্রথমে মিরপুর থানা পুলিশ তদন্ত করে। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০২৪ সালে আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই মামলায় ৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩ জন ইতোমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিলেও রহস্যজনক কারণে মামলাটির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রাসেল আহমেদ আসছেন না সাক্ষী দিতে।

তার বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করা হলেও গা করছেন না এই পুলিশ কর্মকর্তা। সর্র্বশেষ গত ২৭ জুলাই তার আদালতে হাজির হওয়ার কথা থাকলেও উপস্থিত হননি তিনি। ফলে সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে বিচারকার্যক্রম। অপেক্ষাও শেষ হচ্ছে না আসামি ও ভুক্তভোগীদের।

এদিকে সচিবালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, ব্যক্তিগত সহকারীসহ নানা পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এই প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে মাগুরার অন্তত ৩০ বেকার যুবক পথে বসেছে। তাদের কাছ থেকে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে তিন কোটি টাকা।

ভুক্তভোগী মাগুরা শহরের মীরপাড়ার বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেনের অভিযোগ, তার ছেলে মাহবুবুল আলম হাসানকে সচিবালয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে চক্রের সদস্য শাহিনুর কাদির সুমন ১০ লাখ টাকা নেয়।

এ ছাড়া মাগুরা সদরের রূপাটি গ্রামের ওহাব মোল্যার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, একই গ্রামের গোলাম রসুলের ছেলে তানভির, একই গ্রামের ছানোয়ার আলী, ঝিনাইদহের শ্রীফলতলা গ্রামের আবু সাঈদ আল ইমরান, মাগুরা সদরের বাগিয়া গ্রামের শাহিনুর রহমান, মাঝাইল গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হাজীপুর গ্রামের ইমরান সিদ্দিকের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে চক্রটি ৭৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এই ভুক্তভোগীদেরও বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত সুমন চাকরিতে যোগদানের জন্য আলাদা নিয়োগপত্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সচিবালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ দেয়। এসব নিয়োগপত্র ও অফিস আদেশ পেয়ে ভুক্তভোগীরা সচিবালয়ে গেলে চাকরি পাওয়ার ভ্রম কাটে তাদের।

ভুক্তভোগী মোসলেহ উদ্দিন বলেন, তার বোন নুরুন্নাহার ও পরিচিত শফিকুল ইসলামের চাকরির জন্য এই চক্রের হাতে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন তিনি। প্রতারকচক্রটি ভুয়া নিয়োগপত্র ও অফিস আদেশের মাধ্যমে একইভাবে তার সঙ্গেও প্রতারণা করেছে।

প্রতারক সুমন আমার বোন নুরুন্নাহারকে সচিবালয়ে নিয়ে সার্ভিস বুক খুলে বেশ কিছুদিন কাজও করিয়েছে। এমনকি এক মাসের বেতনও দিয়েছে। আঙুলের ছাপ নিয়েছে। কিন্তু সবই ছিল ভুয়া। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক রাসেল (রাজধানীর মিরপুর থানার তৎকালীন এসআই) প্রথম থেকেই আসামিদের গ্রেপ্তারে গড়িমসি করে। এখন তার সাক্ষীর জন্য থমকে আছে বিচার কার্যক্রম।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল শুক্রবার পরিদর্শক রাসেলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।

মিরপুর থানায় দায়ের করা মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুজাহিদ জানান, একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *