রেলওয়ের বেহাল দশা
আবার বিচ্ছিন্ন সিলেট
মহসীন আহেমদ স্বপন : সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম রেলপথে বরমচাল এলাকায় উপবন ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে সব ট্রেনে যাত্রীসংখ্যা কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন ও ব্রিজের কারণে রেল ভ্রমণ অনিরাপদ বলে মনে করছেন যাত্রীরা। তবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্রেন দুর্ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যাত্রীদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্ক নিয়েই তাদের এ পথ দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।
পারাবত ট্রেনের বগির অ্যাটেনডেন্স মো. মামুন আহমদ বলেন, আগের মতো যাত্রী নেই। যাত্রীদের মধ্য আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনার পরদিন তো যাত্রী একেবারে কম ছিল। অনেকে টিকিট কেটেও যায়নি। ট্রেনযাত্রী সুমন মিয়া জানান, আতঙ্কে আছি। তারপরও ট্রেনে করে যেতে হচ্ছে।
কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজের ওই দুর্ঘটনার পর থেকে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। নড়বড়ে ওই রেললাইনের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা। দীর্ঘদিন ধরে ত্রুটিপূর্ণ এই লাইনটি সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ না হওয়ায় যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যাত্রী কমে যাওয়া নিয়ে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. আফছার উদ্দীন বলেন, প্রথমত, যাত্রীদের মধ্য আতঙ্ক বিরাজ করছে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চালু হয়েছে। তারপরও ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। আতঙ্ক দূর হতে একটু সময় লাগবে।
তিনি যাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। ট্রেন দুর্ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
আবার বিচ্ছিন্ন সিলেট : মৌলভীবাজারের বরমচালে ব্রিজ থেকে ছিটকে পানিতে পড়া ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের বগি উদ্ধারের কাজ চলছে। এর ফলে সাময়িকভাবে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের স্টেশন মাস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় শনিবার সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ৩০ মিনিট দেরিতে শ্রীমঙ্গলে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটি লোকাল ট্রেনও স্টেশনে দাঁড়ানো আছে। এছাড়া ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস সিলেট থেকে ছেড়ে এসে বরমচাল ভাঙা ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আসেনি সিলেট থেকে ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসও।
বরমচাল স্টেশন মাস্টার শফিকুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বরমচালে খালে ছিটকে পড়া ট্রেনের বগি উদ্ধারের কাজ চলছে। তাই এই লাইনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে লাইন খুলে দেওয়া হবে।
উদ্ধার কাজ শেষ হতে কত সময় লাগবে বলা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কুলাউড়ার ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার মুহিব উদ্দিন আহমদ। তিনি জানান, খালে বগি থাকায় সেতুর নিচ দিয়ে চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে সেতুটির। তাই দ্রুত বগিটি উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত রবিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকার কাছেই সেতু ভেঙে আন্তঃনগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের কয়েকটি বগি খালে পড়ে যায়। এছাড়া আরও তিনটি বগি স্থলভাগের সীমানায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। মোট পাঁচটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট কাজ শুরু করে। পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় লোকজনও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। এ ঘটনায় নিহত হন চারজন এবং আহত হন শতাধিক যাত্রী। এ দুর্ঘটনার কারণে ২২ ঘন্টা বন্ধ থাকে সারাদেশের সাথে সিলেটের রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ের বেহাল দশা : উন্নয়ন মানে যেমন রেল তেমনি লোকসানের তালিকায়ও আছে রেল। গত ১০ বছরে সরকার রেলওয়েতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। বরাদ্দের পরও প্রতি বছর রেলওয়েতে ভর্তুকি বাড়ছেই। তারপরেও কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছে না রেল। শিডিউল বিপর্যয়, চলন্ত পথে ইঞ্জিন বিকল হওয়া, টিকিট কালোবাজারি, হকারদের উৎপাতসহ নানা কারণে ট্রেনভ্রমণে যাত্রীদের ভোগান্তি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসবের প্রেক্ষিতে রেলওয়ের যাত্রী পরিবহনে বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন লেপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিবহন খাতে বিদ্যমান সমস্যা ও উহা দূরীকরণে করণীয় প্রসঙ্গে একটি বিশেষ প্রতিবেদন শীর্ষক প্রতিবেদনে যাত্রী পরিবহনে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রেলওয়ের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় রেলওয়ে একটি ভঙ্গুর যাত্রীসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলওয়ের উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সংস্থাটি এখনও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। বিশেষ করে জনবল সংকট, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দূরদর্শিতার অভাবে রেলওয়ের বিবর্ণ চিত্র দিনকে দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান বেহাল দশার কথা। রেলওয়ের যাত্রী পরিবহনে বেশকিছু সমস্যা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিবহন খাতে বেহাল অবস্থা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রেলের একটি সাধারণ বগির অতিপরিচিত দৃশ্য হচ্ছে জানালা নেই, দরজা ভাঙা, বিকল ফ্যান, বেহাল অবস্থা বাথরুমের। বেশিরভাগ বগিই থাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। পথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ট্রেন। অতিরিক্ত হকারের চাপ, পকেটমারদের দৌরাত্ম্য, খাবার গাড়ি নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা, টিকিট কালোবাজারি, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, পুরোনো বগি দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া ও মেরামত না করা প্রভৃতি নানা সমস্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ যাত্রীরা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শিডিউল মেনে না চলা, যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে যথাযথ দৃষ্টি না দেওয়া, কোচ অর্থাৎ বগিগুলোর দুরবস্থা, সিংহভাগ ইঞ্জিনের আয়ু ক্ষয়ে যাওয়া, সংশ্লিষ্ট একটি দুষ্টচক্রের দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতি কারণে রেলের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। যাত্রীচাহিদার কারণে মেরামতের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ যাত্রীবাহী কোচগুলো ব্যবহার করা হলেও এগুলো মোটেই সুবিধাজনক ও নিরাপদ নয়। বছরের পর বছর অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর সময়ের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়নের উদ্যোগ না নেওয়ায় রেলের আজকের এই দুরবস্থা। বর্তমান সরকার টানা দুই মেয়াদে এ খাতের সংস্কারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; তবে আরও সংস্কার প্রয়োজন মর্মে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কমলাপুর স্টেশন থেকে দূরদূরান্তে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের ইঞ্জিন প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ে। এতে ওই ট্রেনের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ হাজার হাজার যাত্রীকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। অনেক চেষ্টার পর প্রকৌশলীরা ইঞ্জিন সচল করতে প্রায়ই ব্যর্থ হন। ইঞ্জিন পরিবর্তন করে এক থেকে দু’ঘণ্টা, কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি বিলম্বে ছেড়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশে। এমন অবস্থা চলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-দিনাজপুর রুটসহ অধিকাংশ রুটে।
বিএনপির শাসনামলে রেলওয়ের সংকোচননীতির সমালোচনার পাশাপাশি বর্তমান সরকারের মেয়াদেও এ খাতে অপরিকল্পিত বিনিয়োগের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে চীন থেকে ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয়েছিল আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতা কিংবা প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই। মাত্র সাড়ে চার বছরেই আমদানি করা এসব ডেমুর প্রায় সবই অচল হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে সাতটি। এসব মেরামতের দক্ষতা কিংবা কারখানা আমাদের নেই। অথচ এগুলো আমদানি করা হয়েছিল এসব বিবেচনা না করেই।
রেলের ওয়ার্কশপগুলোর করুণ চিত্রের বর্ণনা উঠে আসে প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের কোচ বা বগিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে রেলের সার্বিক অব্যবস্থাপনা, আন্তরিকতার অভাব এবং সেবার নি¤œমানের চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন কিছু আমদানি করা ব্যতীত প্রায় সব বগি বা কোচ পুরোনো ও জরাজীর্ণ। অথচ রেলের জন্য চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরে দুটি ওয়ার্কশপ রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওয়ার্কশপগুলো বর্তমানে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। রেলের কোনো যন্ত্রাংশ সেখানে এখন মেরামত হয় না। সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে রেলের নি¤œমানের যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, যা অল্প কিছুদিন পর আবার নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ওয়ার্কশপে যদি এসব মেরামত হতো তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাও বেঁচে যেত এবং কাজও অনেক শক্ত বা দীর্ঘস্থায়ী হতো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে রেলের দুটি ওয়ার্কশপে এখন আর কোনো কাজ হয় না। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী দেশে রেল ওয়ার্কশপের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
সমস্যাগুলোর বাইরে টিকেট কালোবাজারি, খাবার গাড়ি নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসা, অনুমোদনহীন হকার সমস্যা, পকেটমার, টয়লেট সমস্যা, টিকিট চেকারদের দ্বারা যাত্রীদের অহেতুক হয়রানির বিস্তারিত প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এছাড়া রেলের প্রচুর জায়গাজমি দিন দিন বেদখল হয়ে যাওয়ার বিষয়েও বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে রেলের সেবার মানোন্নয়নে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, উন্নতমানের কোচ ক্রয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা; বিদ্যমান কোচগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা; ট্রেনের বাতি, ফ্যান, জানালা অতি দ্রুত মেরামত ও পুনঃস্থাপন করা, কোচের বাইর ও ভিতর সীটসহ পরিবেশ আধুনিকায়ন, পরিত্যক্ত ও অপদখলকৃত জমি উদ্ধার করে সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিটি কোচে একজন করে অ্যাটেনডেন্ট রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং টিকেট কালোবাজারী রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।