আলাদা ওয়ার্ড না থাকায় আতঙ্কিত অন্য রোগীরা
এম এ স্বপন : হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের আলাদা ওয়ার্ড না থাকায় আতঙ্কিত অন্য রোগী ও স্বজনরা। ছোঁয়াচে না হলেও এডিস মশার মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যায় অন্যের শরীরে। তাই হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মশারি ব্যবহারে সচেতনতার পাশাপাশি বিশেষ ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেবার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। সবধরনের সতর্কতা সত্ত্বেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় সাজিদ। আক্রান্তদের সবাইকে একটি করে মশারি দেয়া হলেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে বেশিরভাগ রোগীর মধ্যে।
রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, তবে দেশের অন্যত্র স্বাভাবিক। চলতি বছরের শুরু থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ৬ হাজার ৪২৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ঢাকার বাইরে মাত্র ৪ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত তিন দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৭৯ জন। গত বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ২৩৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত বছর চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতিও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। তবে এবার চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ স্বাভাবিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গৃহীত পদক্ষেপ ও সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমের পরও ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। মশক নিধন করে ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারাও অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছেন। তবে সংশ্নিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের কাজের সমন্বয়হীনতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭৪ জন আক্রান্ত এবং ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পরই আগস্ট মাসে এক হাজার ৭৯৬ জন আক্রান্ত এবং সর্বোচ্চ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পর জুলাই মাসে আক্রান্ত হন ৯৪৬ জন এবং মৃত্যু হয় ৪ জনের। জুন মাসে ২৯৫ জন আক্রান্ত এবং ৩ জনের মৃত্যু। অক্টোবরের মাত্র তিন দিনেই ১৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন ও খুলনা বিভাগে মাত্র ১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। তবে তারা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
গত বুধবার পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সবেচেয়ে বেশি লোক; ৮৪৪ জন। এখানে এখনও ৫৫ জন চিকিৎসাধীন। এর পরই ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০৩ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৬৮ জন, মুগদা হাসপাতালে ৫২২ জন, মিটফোর্ডে ৪২০ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৩২০ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩১৮ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২৯৬ জন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২৯৫ জন, ইবনে সিনায় ২৮৮ জন, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২৭২ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ২৬৩ জন, বারডেম হাসপাতালে ২৪৮ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ২৪৬ জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২৫ জন আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া ২৫৪ জন রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে চিকিসাধীন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে, চলতি বছর জুলাই মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা, জুন মাসে মোট আক্রান্তের প্রায় সমান। অক্টোবর পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ হওয়ার আশঙ্কা থাকায়, আগে থেকেই হাসপাতালগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ রোগীদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে করা জরিপে রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনে এডিস মশার ঘনত্ব ছিল ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এ হার ছিল ৩২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু জুলাই মাসে তা ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান-১ নম্বরে এডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকিমাত্রা ছিল ৭০ শতাংশ। এর পরই মিরপুর ১১ নম্বরে ৬০ শতাংশ। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মণিপুরিপাড়া, নিকেতন. গাবতলী ও লালমাটিয়ায় এই হার ৪০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকির সহনীয় মাত্রা ২০ শতাংশ।
হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত হচ্ছেন একই ওয়ার্ডে থাকা অন্য রোগীরা। ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্যদের মধ্যেও যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য আক্রান্তদের বিশেষ ওয়ার্ডে স্থানান্তরের আহ্বান সাধারণ রোগীদের।
এদিকে বিশেষ ওয়ার্ড না হলেও বিশেষ কর্নার করা হয়েছে বলে জানান সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া।
বর্ষার শুরুতেই ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু মশার প্রকোশ। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রন শাখার তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় শুধু রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩০ জন রোগী। আর গত ১১ দিনে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এক হাজার পাঁচ শ ৪৬ জনে। যা গত পুরো মাসে আক্রান্তের সমান। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুও ঘটেছে। এতে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে নগরবাসীর জনজীবনে।
তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং রোগীর সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত হারে বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও এটির মূল কারণ হিসেবে জন সচেতনার অভাবকে দুষছেন ঢাকার দুই সিটির দায়িত্বশীল স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কিংবা প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হলেও শুধুমাত্র জনসচেতনার অভাবেই এটি নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই ক্রমেই অনিয়ন্ত্রিত হারে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি করছেন তারা। তাই জনগণকে সচেতন হওয়ার জোর দাবিও জানাচ্ছেন তারা।
কিন্তু নগরবাসী বলছেন, জনসচেতনার উপর দায় চাপিয়ে দুই সিটি ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রনে সিটি করপোরেশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এমনকি কোনো কোনো ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত দেড়দুবছরে মশার ওষুধ তো দূরের কথা সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন কর্মীদেরও দেখা মিলে নি কালেভদ্রে। আবার কোথাও কোথাও একবার ওষুধ ছিটালেও দীর্ঘদিন ধরে আর ঔষুধ ছিটানোর কোনো লক্ষণ থাকে না। এসব কারণেই মশার উপদ্রব বেড়েছে এবং রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।