নিজস্ব প্রতিবেদক : বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মালিকদের বিরুদ্ধে এবার কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, বাংলা টিভির শেয়ার হস্তান্তরের নামে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হলেও তার রাজস্ব দেয়া হয়নি। বাংলা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সৈয়দ সামাদুল হক, চেয়ারম্যান কে এম আখতারুজ্জামান, আর পরিচালক মীর নুর উস শামস শান্তনু, কে এম রিফাতুজ্জামান ও ভাইস চেয়ারম্যান বিটিভির সাবেক সংবাদ পাঠক মনিরুল ইসলাম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরে সংক্রান্ত অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, বাংলা টিভি নামে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত স্যাটেলাইট টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সামাদুল হক, প্রতিষ্ঠানটির চালুর পর থেকেই যন্ত্রপাতি আমদানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পযায়ে কৌশলে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সৈয়দ সামাদুল হক ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লন্ডনে বাংলা টিভি নামে একটি টিভি চ্যানেল পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে সেই টিভি চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর মাধ্যমে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বাংলা টিভি নামে একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের অনুমোদন নেন।
টেলিভিশনটি পরিচালনার জন্য বিএনপি-জামায়াতপন্থী সিলেটের বিতর্কিত ব্যবসায়ী রাগীব আলীকে চেয়ারম্যান করা হয়। তার কাছ থেকে শেয়ার বিক্রির নামে কয়েক কোটি টাকা নেন সামাদুল এবং রাগীব আলীর ৮৩, সিদ্ধেশরী, রমনাস্থ ভবনে টেলিভিশনের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন। কিন্তু বিনিয়োগকৃত সেই অর্থের কোনও কর দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মামলায় রাগীব আলী কারাগারে গেলে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ী আখতার ফার্নিচারের মালিক কে এম আখতারুজ্জামান, তার ছেলে কে এম রিফাতুজ্জামান ও বিটিভির সংবাদ পাঠক মনিরুল ইসলামের কাছে শেয়ার বিক্রি করেন।
টিভি চ্যানেলটির শেয়ার বিক্রির নামে কয়েক দফায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা নেন সামাদুল হক। এর মধ্যে মাত্র কয়েক কোটি টাকা টিভিতে বিনিয়োগ দেখালেও বাকি টাকা আত্মসাত ও বিদেশে পাচার করেন। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর বনানীতে ( নাসা হোল্ডিং , রোড নম্বর-৪, ব্লক-সি, হাউজ নম্বর-২৬, অ্যাপার্টমেন্ট-বি-১ ) বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। এছাড়া, বিজ্ঞাপনবাবদ আয় কম দেখিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার পাশাপাশি তা পাচার করে আসছেন সামাদুল হক। সৈয়দ সামাদুল হক বাংলা টিভিতে প্রতিনিধি নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিলেও এ খাত থেকে আয়ের বিপরীতে এক টাকাও রাজস্ব দেননি। প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নিয়োগের নামে অর্থ নিলেও গত ৫ বছরে কোন প্রতিনিধিকে বেতন-ভাতা প্রদান দুরে থাক, নিয়োগ পত্রও দেয়া হয়নি। কোটি কোটি টাকা আয় করলেও সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিতে প্রতিষ্ঠানকে লোকসানি দেখিয়ে মাসের পর মাস কর্মীদের বেতন দেয়া হয় না।
বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলা টিভির শেয়ার বিক্রির অনিয়মের বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন মহলের নজরে এলে শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। যার কারণে বাংলা টিভি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন অবধি টিভির শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। এদিকে, বাংলা টিভির এমডি সামাদুল হকের ভাগ্নে ও টিভির পরিচালক মীর নুর উস শামস শান্তনু অবৈধভাবে অর্জিত কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের হয়বত নগরে একটি আলিসান ভবন নির্মাণ করেন। প্রতিনিধিদের টাকায় যখন তখন দেশ-বিদেশ ভ্রমণ তার নিত্যদিনের ঘটনা ।
এ নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। এছাড়া বাংলা টিভিতে বিনিয়োগকারী এমএলএম ব্যবসায়ী বিটিভির সংবাদ পাঠক মনিরুলের বিনিয়োগ করা কয়েক কোটি টাকার উৎস নিয়ে আগে থেকেই অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক সৈয়দ সামাদুল হক, ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ নিউজ সার্ভিস-বিএনএস নামে একটি নিউজ এজেন্সি চালু করেন।
সেটি বন্ধ হয়ে গেলে পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৫ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব ও বিএনপিপন্থী জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি মোজাম্মেল হক ও বিএনপিপন্থী ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রয়াত নেতা আবদুস শহিদকে সঙ্গে নিয়ে কারওয়ান বাজারে গড়ে তুলেন ডাউনলিংক টিভি, চ্যানেল এস। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেটি বন্ধ হয়ে গেলে মাইটিভির মালিক নাসির উদ্দিন সাথীর দায়ের করা চেক জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা জেল খাটেন তিনি। পর জামিনে বের হয়ে লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে বাংলা টিভির মালিকানা নিয়ে চ্যানেলটির প্রতিষ্ঠাতা ফিরোজ খানের সাথে দ্বন্দ্বের জেরে সেখানেও জেল খাটেন সামাদুল হক। এদিকে, অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বাংলা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সামাদুল হকসহ প্রতিষ্ঠানটির ৪ জন পরিচালককে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক ।
রোববার দুদকের পক্ষে এ সংক্রান্ত নোটিশ জারি করা হয়। দুদকের উপ পরিচালক সেলিনা আখতার মনি স্বাক্ষরিত নোটিশে উল্লেখ করা হয়, বাংলা টিভির শেয়ার হস্তান্তরের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত ও অর্থ পাচারের সুষ্ঠূ অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সামাদুল হক, চেয়ারম্যান কে এম আখতারুজ্জামান, পরিচালক মীর নুর উস শামস শান্তনু ও কে এম রিফাতুজ্জামানের বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা প্রয়োজন। এজন্য তাদের আগামী ৭ জুন, দুদকের প্রধান কাযালয়ে হাজির হতে বলা হয়।