বিশেষ প্রতিবেদক : আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি দীর্ঘদিন যাবত যুক্তরাষ্ট্রের নাম ব্যবহার করে বক্তৃতা বিবৃতিতে আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পক্ষে আছে – এই মর্মে বিভিন্ন গুজব ও প্রোপাগান্ডাও চালানো হয়ে আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিএনপির অবস্থান কী – তা বোধহয় তারা ভেবে দেখেন নি। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে আমাদের অনেকেই হয়তো অবগত নন যে, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে বিএনপি টায়ার থ্রি স্তরের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত। সম্প্রতি কানাডার আদালত পঞ্চম বারের মত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গটি কি নিছক কথার কথা নাকি এর ভিত্তি রয়েছে তা খতিয়ে দেখা যাক।
বিএনপি কেন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত:
২০১২ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাহবাগের গণজাগরণ, হেফাজতের ১৩ দফা ও ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি জামায়াত সারাদেশে যে নৈরাজ্য ও সহিংসতা চালিয়েছিল তার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপির ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে একটি অরাজকতা সৃষ্টিকারী দল হিসেবে। বিশেষত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, নিরীহ জনগণের ওপর পেট্রোল বোমা হামলা, অগ্নিসন্ত্রাস এবং সর্বোপরি জামায়াত শিবির ও মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কান্ট্রি রিপোর্টে বিএনপি বাংলাদেশের নাশকতা সৃষ্টিকারী ও জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের মদদদাতা সংগঠন হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এ বিষয়টি উঠে আসে বিএনপির দলীয় পরিচয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকারীদের আবেদন আদালতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি টায়ার থ্রি স্তরের সন্ত্রাসী সংগঠন:
২০১৪ সাল থেকে বিএনপির দলীয় পরিচয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা একজন আবেদনকারীর আবেদনও মঞ্জুর করে নি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অথরিটি। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও নিউজার্সির অভিবাসন সংশ্লিষ্ট আদালত প্রদত্ত রায়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিএনপিকে ‘টায়ার-থ্রি’ স্তরের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
যেকোনো স্তরের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে উক্ত সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার প্রাথমিক যোগ্যতা হারায় যা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। বিএনপির দলীয় পরিচয়ে আবেদনকারীদের বিভিন্ন রাজ্যে কারাবন্দি করে রাখা হয়। শুধুমাত্র টেক্সাসের এলপাসো ডিটেনশন সেন্টারে বিএনপির পরিচয়ে আশ্রয় প্রার্থনাকারী ৮০ জনের বেশি বাংলাদেশীর আটকের তথ্য জানা যায়। মুক্তির দাবিতে অনশন করায় বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল।
আদালতের রায়:
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের আদালতের দেওয়া রায়গুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা ও সহিংসতা সৃষ্টি এবং গণতান্ত্রিক সরকারকে বলপ্রয়োগ করে উৎখাতের চেষ্টা সহ ১৬টি কারণ উপস্থাপন করেছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ। এতে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের বিবরণও স্থান পেয়েছে।
টায়ার থ্রি সন্ত্রাসী সংগঠন কী?
টায়ার থ্রি সন্ত্রাসী সংগঠন বলতে এমন সংগঠনকে বোঝায় যা নিষিদ্ধ নয় এবং যাদের গঠনতন্ত্র প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। কিন্তু নাশকতা সৃষ্টি, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ও সহিংস কর্মসূচিতে ইন্ধন দেওয়ার দালিলিক তথ্য প্রমাণ থাকলে উক্ত সংগঠনকে টায়ার থ্রি তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন বা আনডেসিগনেটেড টেরর গ্রুপ বলা হয়।
২০১৫ সালে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের টায়ার থ্রি সন্ত্রাসী তালিকা থেকে দলের নাম বাদ দিতে লেক্সিসনেক্সিস নামে একটি ল ফার্মকে নিয়োগ করেছিল। কিন্তু হোমল্যান্ড সিকিউরিটি থেকে ইতিবাচক সাড়া পায় নি। বিএনপির দলীয় পরিচয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের আবেদন সাম্প্রতিক সময়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের টায়ার থ্রি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত।
কানাডার আদালতের রায়:
কানাডার আদালত পাঁচ বার বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে রায় প্রদান করেছে। প্রকৃতপক্ষে কানাডার আদালত যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের নীতিমালা অনুসরণ করেছে মাত্র। সহিংসতা সৃষ্টি, বল প্রয়োগ এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের চেষ্টা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ইন্ধন ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দান ইত্যাদি অভিযোগে বিএনপিকে চার বার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কানাডার আদালত। এবার বিএনপি মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ্যাডেলম্যান এন্ড কোং ল অফিস এবং স্টুয়ার্ট শর্মা হার্সাইনি ল ফার্মকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু আদালত তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে পূর্বের রায় বহাল রাখে।
রায় নিয়ে মিথ্যাচার:
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যমে কানাডার আদালত কর্তৃক পঞ্চম বারের মত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণার খবরটি প্রকাশিত হলেও বিএনপিপন্থী গুটিকয়েক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। ইংরেজি ভাষা বা আইন সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকার কারণে এটি হতে পারে। অন্যথায় তারা প্রতারণামূলকভাবে মিথ্যাচার করেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে রায়ের একটি পৃষ্ঠার একটি পয়েন্ট দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয় নি। প্রকৃতপক্ষে এই দাবি বিএনপির নিয়োগকৃত আইনজীবী এডভোকেট রাজ শর্মার। সম্পূর্ণ রায়ের কপি অনলাইনে পাওয়া গেলেও তারা সেটি উপস্থাপন করে নি। রায়ে বিএনপিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন না বললেও বিএনপির নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এবং গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, বিএনপিকে টায়ার থ্রি স্তরের বা আনডেসিগনেটেড সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিএনপির নিয়োগকৃত আইনজীবী এ্যাডেলম্যান নিজেই বলেছেন বিএনপিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিবর্গ রয়েছে।
আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি:
আইন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা যার আছে তিনি অবশ্যই জানেন যে আপীল প্রত্যাখ্যান করা মানে পূর্ববর্তী রায় বহাল থাকা। বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে কানাডার নিম্ন আদালত যে রায় প্রদান করেছিল তা চার বার আপীল করেও উচ্চ আদালতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে দেওয়া রায়ই বহাল রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইমিগ্রেশন নীতিমালা উদার। সেখানে সহজেই বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়। তাহলে বিএনপির পরিচয়ে আবেদনকারীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হল কেন?
বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বিএনপি সংশ্লিষ্টতার কারণে। বিএনপিকে যদি সন্ত্রাসী সংগঠন না বলা হয়, তাহলে আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
উল্লেখ্য, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ও সেটন হল ইউনিভার্সিটি সহ যুক্তরাষ্টের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিকে টায়ার থ্রি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্তির বিষয়বস্তু ইমিগ্রেশন ল-এর পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত হোক তা আমরা কখনোই কামনা করি না। কিন্তু কর্মফল বলে একটি কথা রয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা অন্যের জন্য ফাঁদ পাতায় ব্যস্ত থেকে কখন নিজেরাই ফাঁদে আটকে গেছে তা বোধহয় এখনো তাদের বোধগম্য হয় নি। আশাকরি তারা ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসবে।