বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চিফ মেডিকেল অফিসারের ব্যাংক হিসাব জব্দ, বেতন বন্ধ মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এনবিআরের চিঠি 

Uncategorized অপরাধ অর্থনীতি আইন ও আদালত ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

কর খেলাপী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রফেসর ডা. একেএম ফজলুল বারী বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চিফ মেডিকেল অফিসার।

 

নিজস্ব প্রতিবেদক :  তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চিফ মেডিকেল অফিসার, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ই-টিআইএন নিয়েছেন ২০১৫ সালে। ২০১৮-১৯ করবর্ষে প্রথমবার রিটার্ন দাখিল করেছেন। আর ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত চার করবর্ষের রিটার্ন দেননি এই করদাতা। এই চার করবর্ষের রিটার্ন দাখিল করতে ২০২১ সালে এই করদাতাকে নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশের কোনো জবাব দেননি করদাতা। প্রথম রিটার্নে আয় দেখিয়েছেন নামমাত্র। করদাতার সঠিক আয় ও সম্পদ জানতে করদাতার ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করা হয়। যাতে পাওয়া যায় বিপুল নগদ টাকা, এফডিআর। তদন্তে নেমে কর অফিস ওই করদাতার নগদ টাকা ছাড়াও ফ্ল্যাট, ব্যাংক ঋণ, গাড়ি-সবই পায়। নগদ টাকা ও আয়ের ওপর কর ফাঁকি পাওয়া যায় প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। প্রাইভেট প্র্যাকটিস, বিভিন্ন কোর্সে আয় ও ব্যাংক সুদের ওপর এই ফাঁকি পাওয়া যায়। কর ফাঁকি দেয়া কর পরিশোধে করদাতাকে নোটিশ দেয়া হয়।


বিজ্ঞাপন

ততক্ষণে হুঁশ ফিরে আসে করদাতার। শুনানিতে অংশ নেন করদাতা। প্রমাণ দেয়ায় কর কমে দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি টাকা। ফাইনাল ধার্য করা এই কর পরিশোধে অনবরত নোটিশ, তাগাদাপত্র দেয় কর অফিস। শেষে করদাতা কর পরিশোধ করেনি। শেষে আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী খেলাপি করদাতা হিসেবে এই করদাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অংশ হিসেবে জব্দ করা হয় ব্যাংক হিসাব। এখানেই শেষ নয়, খেলাপি করদাতা হিসেবে এই করদাতার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সংশ্লিষ্ট অফিসকে চিঠি দেয় কর অফিস। করদাতার বেতন বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট অফিসে চিঠি দেয়া হয়েছে। করদাতার মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) চিঠি দেয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

পুঁজিবাজারে নামে-বেনামে কোনো বিনিয়োগ রয়েছে কিনা-তা জানতে সিডিবিএল-কে চিঠি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পৃথকভাবে এসব চিঠি দেয়া হয়। খেলাপি এই করদাতা হলেন প্রফেসর ডা. একেএম ফজলুল বারী। তিনি কর অঞ্চল-১২, ঢাকা, সার্কেল-২৫২ এর নিবন্ধিত করদাতা। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চিফ মেডিকেল অফিসার। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। উল্লেখ্য, করখেলাপি হিসেবে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কর অফিস আয়কর আইন অনুযায়ী প্রথমবার এনটিএমসি-কে চিঠি দিয়েছে।

সূত্রমতে, ডা. একেএম ফজলুল বারী ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ই-টিআইএন নেয়। ২০১৮-১৯ করবর্ষে এই করদাতা প্রথমবার সার্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে প্রথমবার রিটার্ন দিয়েছে। তাতে আয় দেখিয়েছেন ৮ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু এর আগে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ করবর্ষ পর্যন্ত চার কর বর্ষের কোনো রিটার্ন দেয়নি করদাতা। পরে ৯৩ ধারা অনুযায়ী ওই বছরের ২৩ মার্চ এই করদাতাকে নোটিশ করা হয়। কিন্তু করদাতা নোটিশে কোনো সাড়া দেয়নি। পরে কর অফিস ২০২১ সালের ১৮ মে এই করদাতার ব্যাংক হিসাব তল্লাশি দেয়; যাতে পূবালী ব্যাংক শাহবাগ এভিনিউ শাখা, পূবালী ব্যাংক সোনারগাঁও শাখা, ইউসিবি ব্যাংক মিরপুর রোড শাখায় নগদ শাখা, সঞ্চয়ী হিসাব ও এফডিআর পাওয়া যায়। এছাড়া ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেডে এই করদাতা ও তার স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাটের অধীনে একটি লোন পাওয়া যায়। করদাতার সম্পদ অনুসন্ধানে কর পরিদর্শক তদন্ত করেন। এতে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক একজন থাইরয়েড মেডিসিন ও ইন্টারভেনশনাল বিশেষজ্ঞ।

চাকরির পাশাপাশি তিনি ধানমন্ডিতে দি থাইরয়েড সেন্টার লিমিটেডে সপ্তাহে পাঁচ দিন প্র্যাকটিস করেন। এছাড়া এটার ময়মনসিংহ শাখায় সপ্তাহে একদিন প্র্যাকটিস করেন। এই করদাতা নিজস্ব এই প্রতিষ্ঠানের আয় রিটার্নে দেখাননি। এছাড়া ব্যাংক সুদের আয় ও রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে থাকা ফ্ল্যাটও দেখায়নি। তিনি থাইরয়েড বিষয়ে বিভিন্ন কোর্স করান, যার আয় রিটার্নে দেখায়নি। তদন্তে পাওয়া ও ব্যাংক তল্লাশি করে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে করদাতার আয় ও কর হিসাব করা হয়েছে।

যাতে দেখা গেছে, করদাতার ২০১৭-১৮ করবর্ষে এফডিআর আয় পাওয়া গেছে ১ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার ২২৪ টাকা। আর ব্যাংকের স্থিতি পাওয়া গেছে ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩৯ টাকা। আর ২০১৬-১৭ করবর্ষে এফডিআর ব্যালেন্স ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫১ টাকা, স্থিতি ২৫ লাখ ১৯ হাজার ৪৯ টাকা, ২০১৫-১৬ করবর্ষে এফডিআর ব্যালেন্স ২ কোটি ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮৭৫ টাকা, ২০১৪-১৫ করবর্ষে এফডিআর ব্যালেন্স ১ কোটি ৭৬ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৮ টাকা। আর ২০১৭-১৮ করবর্ষে এই করদাতা ও তার স্ত্রীর নামে ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেডে একটি ফ্ল্যাটের ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি লোন পাওয়া গেছে।

অপরদিকে, করদাতা ২০১৭-১৮ করবর্ষে আয় পাওয়া গেছে এক কোটি ৭৪ লাখ ৭৬ হাজার ২৫২ টাকা, ২০১৬-১৭ করবর্ষে এক কোটি ৮০ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭২ টাকা, ২০১৫-১৬ করবর্ষে এক কোটি ৩৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭১ টাকা ও ২০১৪-১৫ করবর্ষে ২ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার ৯১৭ টাকা। করদাতার চার করবর্ষের আয় হিসাব করে কর নির্ধারণ করা হয়। এতে দেখা গেছে, চার করবর্ষে আয়ের ওপর ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬৪৯ টাকা কর নির্ধারণ করা হয়। পরে করদাতা কিছু প্রমাণ দেয়ায় কর ২ কোটি ১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

কর অঞ্চল-১২, ঢাকার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমের কাছে  বলেন, এই করদাতা কখনো রিটার্ন দাখিল করেনি। আমরা নোটিশ করেছি, কোনো জবাব দেননি। পরে ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করে তথ্য নেয়া হয়। এছাড়া কর পরিদর্শক তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য ও তদন্তে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রায় ৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা কর ধার্য করা হয়।

কর পরিশোধে গত বছরের আগস্ট মাসে ডিমান্ড নোটিশ করা হয়। করদাতা নিজে শুনানিতে অংশ নেয়। পরে কয়েকটি খাতে প্রমাণ দেয়ায় তা ডিসিটি মেনে নেয়। কর কমে প্রায় দুই কোটি এক লাখ টাকা ধার্য হয়। কর পরিশোধ করবেন বলে করদাতা প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো কর পরিশোধ করেনি। কর পরিশোধে বারবার তাগাদাপত্রও দেয়া হয়।

করদাতা কোনো আপিল করেনি। ফলে আয়কর আইন অনুযায়ী, কর খেলাপি হিসেবে কর অফিস থেকে ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক কে  চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কর খেলাপি হিসেবে এই করদাতার বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। করদাতার মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করতে এনটিএমসি-তে গতকালকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার করেন একেএম ফজলুল বারী। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য কর অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট অফিসকে দেয়া চিঠির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে তিনি গণমাধ্যম কে  জানিয়েছেন। কর খেলাপির বিষয়ে তিনি গণমাধ্যম কে  বলেন, কর ধার্য করার পরও আমি তো আপিল করার জন্য আইনত ৪৫ দিন সময় পাই। এখনো তো ৪৫ দিন শেষ হয়নি। আগামীকাল আমি আপিল করব। ২০২১ সালে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করতে কর অফিস চিঠি দিয়েছেন কি না,  এমন প্রশ্নে তিনি গণমাধ্যম কে  বলেন, আমরা কোনো চিঠি পাইনি। কর অফিস কর ধার্য করার পর আমাকে চিঠি দিয়েছে। আমার কাছে সেই চিঠি আছে। আমি রিটার্ন দিয়েছি, কিন্তু সেই রিটার্ন সেখান থেকে উধাও হয়ে গেছে। একটা বড় গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এসব করিয়েছেন বলেও  গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন তিনি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *