বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ রক্ষায় ইটভাটার বিকল্প হিসেবে অভয়নগরে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি পালন 

Uncategorized কর্পোরেট সংবাদ খুলনা গ্রাম বাংলার খবর জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

পরিবেশ দিবস উপলক্ষে নওয়াপাড়া মডেল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে বৃক্ষ রোপন করেছেন কতৃপক্ষ। 


বিজ্ঞাপন

 

সুমন হোসেন, (যশোর) :  পৃথিবীতে যারা যোগ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে, তারাই টিকে যাবে। আর যারা টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে, পিছিয়ে পড়বে তারা হারিয়ে যাবে। আদিম সমাজব্যবস্থায় প্রাণের জন্মের প্রাথমিক সময়কালে অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও ছিল প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত। সময়ের বিবর্তনে প্রকৃতির ভালোবাসায় লালিত পালিত মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল আয়ত্ত করে। তারপর থেকে মানুষ প্রকৃতির হাতে নিজেদের ভাগ্যকে ছেড়ে না দিয়ে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে মত্ত হয়, প্রভুত্ব করতে শুরু করে। মানুষ দিনে দিনে নিজেদের সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ গ্রাস করতে থাকে। অবস্থাক্রমে প্রকৃতি একসময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ঠিকই কিন্তু বিরূপ রূপ ধারণ করে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে। কারণ মানুষ নামক জীবকুল মাটি, পানি ও বায়ু কোনো কিছুর ওপরই প্রভাব বিস্তার করতে ছাড় দেয়নি।


বিজ্ঞাপন

পৃথিবীতে মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক হারে প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাবও বাড়তে থাকে। ১৮০০ সালে যেখানে পৃথিবীতে মানুষ ছিল মাত্র ১০০ কোটি সেখানে এখন সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০০ কোটির ওপরে মানুষ। মোটামুটিভাবে এখন প্রতি ১১ বছরে ১০০ কোটি মানুষ বাড়ছে পৃথিবীতে। জ্যামিতিক হারে এ মানুষ বৃদ্ধিতে আদি কৃষিভিত্তিক সমাজ বিকশিত হয়েছে শিল্প সমাজে। মানুষ তার চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রগতির পথে যত এগিয়েছে, আহার, আবাসন, আভরণ, আড়ম্বর, আভিজাত্য যত বেড়েছে, প্রভুত্ব যতই রেড়েছে, ততই প্রকৃতির প্রতিশোধমুখী আগ্রাসনে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে মানব সমাজ ও পরিবেশ। পরিবেশের ক্যানভাসটা ছোট নয় একেবারেই, বিশাল-ব্যাপক তার বিস্তৃতি। বিশাল ক্যানভাসের একটা অংশমাত্র ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়া মানুষের আবাসন চাহিদা। মানুষের এ আবাসন চাহিদা পূরণের অন্যতম উপকরণ ইট। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ইট উৎপাদিত হয় যার জন্য প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট মাটি যা ৩৮০০ হেক্টর জমি থেকে সংগ্রহ করা হয়। জ্বালানি হিসেবে ৫০ লাখ টন কয়লা ও ৩০ লাখ টন কাঠ ব্যবহৃত হয়। যা থেকে বছরে প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে যোগ হয়ে থাকে। দেশের অবকাঠামো নির্মাণের জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত চাহিদা পূরণে প্রায় ৮ হাজার ইটভাটায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রতিনিয়ত শ্রম দিয়ে চলেছে। সরকারি নীতিমালা মোতাবেক ইট ভাটা পরিচালিত হোক বা না হোক সরকার এখান থেকে রাজস্ব আয় করে থাকে যা জিডিপিতেও ভূমিকা রাখে।

পৃথিবীব্যাপী মানুষ ধীরে ধীরে পরিবেশ সচেতন হওয়াতে মাটি পোড়া ইটের বিকল্প চিন্তা শুরু হয়। কারণ পৃথিবীতে ১৫০০ বিলিয়ন ইট তৈরি করার ফলে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা পরিবেশবিদরা অনুভব করেন। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষিজমির টপ সয়েল ব্যবহৃত হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে একদিকে যেমন ব্যাপক প্রভাব পড়ে তেমনি বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড যোগ হওয়ায় পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় দারুণভাবে। তাই ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্ট, বালি ও পাথর দিয়ে ব্লক তৈরি করে তা ব্যবহারের ভাবনা আসে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার এ ভাবনা থেকেই ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অবকাঠামো নির্মাণের কাজে ইটের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে ব্লক ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ক্রমান্বয়ে সরকারি উন্নয়ন কাজে ব্লক ব্যবহারের নীতিমালা প্রকাশ করে। সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি নির্মাণকাজে ১০ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শতভাগ ব্লক ব্যবহারের পরিকল্পনা বা নির্দেশনা দেয়।

জনগণ দেখছে সরকারি নির্মাণকাজের সিংহভাগ ক্ষেত্রে এখনো ব্লকের পরিবর্তে মাটি দিয়ে পোড়ানো ইটের ব্যবহারই বেশি চলছে। স্বাধীনতার পর থেকে এমন কত জনকল্যাণের প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষ দেখেছে তার হিসাব রাখা কঠিন। প্রস্তুতিবিহীন লক্ষ্যপূরণ কোনো দিন সম্ভব হয় না। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহারের প্রজ্ঞাপনের পরিণতিও একই হয়েছে। দেশে জবাবদিহিতাহীন, দায়বদ্ধতাহীন যে সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে প্রজ্ঞাপন জারি পর্যন্ত দায়িত্বের সীমারেখা তারপর তা বাস্তবায়ন সম্পাদন কারও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাই এখনো দেশে সনাতনী পদ্ধতিতে ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে। শুধু সনাতনী পদ্ধতিই নয়, এই ইটভাটাগুলোর মধ্যে অর্ধেকই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ না করে অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। জনগণ বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছে ইটভাটায় সরকারি অভিযান চলছে, লাখ লাখ টাকা জরিমানা আদায় হচ্ছে কিন্তু তারপরও অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা কমছে না। এখানে রাজনীতি আর আমলাতন্ত্রের একটা সম্মিলিত উদ্যোগ থাকার কারণে জনগণ এ সমস্যার তল খুঁজে পাচ্ছে না। দেশের পরিবেশ রক্ষায় সামগ্রিকভাবে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। সরকার উদ্যোগী হলে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব। কৃষিজমি রক্ষা, ফসল রক্ষা, স্বাস্থ্য রক্ষা, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির জন্যও সরকারি আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। ইট ব্যবহারের ক্ষতি নিরূপণ করে, বিচার-বিশ্লেষণ করে সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহারের নতুন নীতি গ্রহণ করতে হবে।

সরকারি নিয়মনীতি ভেঙে ইটভাটা কোথায় স্থাপন হচ্ছে, কোন অলৌকিক ক্ষমতা বলে তা পরিচালিত হচ্ছে তা জানলেও বলার অধিকার নেই কারও। আর যাদের অধিকার আছে তাদের তথাকথিত দূরদৃষ্টি, জনকল্যাণ ভাবনা, পরিবেশ সচেতনতা এবং ধারাবাহিক দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির ফলে আজও ব্লক ব্যবহারের কার্যক্রমের অগ্রগতি হয়নি। চীন যেখানে ৫০ বছর আগে ইট ব্যবহার বন্ধ করেছে, সেখানে আমরা নীতি-কৌশল তৈরি করে কাজীর খাতায় জমা রেখেছি। তাই সরকারকেই উদ্যোগী হয়ে দ্রুততম সময়ে ইটভাটার বিরূপ প্রভাব থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজন শুধু দেশ ও জাতির কল্যাণ ভাবনায় আন্তরিক প্রয়াস। আগামীকাল বিশ^ পরিবেশ দিবস। আমরা যেন বিষয়টি ভুলে না যাই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *