সাবেক পররাষ্ট্র  প্রতিমন্ত্রী শাহারিয়ার আলম ভূমিহীন হলেও দুই পুত্র অস্বাভাবিক বিত্তশালী, বাদ পড়েনি তার পিএস সিরাজের বিত্তবৈভব!

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন রাজনীতি রাজশাহী সারাদেশ

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ  প্রতিবেদক  : একসময় তিনি ছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। রাজশাহী শহরের বাসিন্দা হলেও ঢাকার ব্যাবসায়ী ছিলেন তিনি। ফলে রাজশাহীতে শাহরিয়ার আলমের তেমন কোনো নাম-ডাক ছিল না। নাম-ডাক কুড়াতে ২০০৫ সালের দিকে রাজনীতিতে আসার খায়েস জাগে তাঁর। ওই সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে ধর্না দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিএনপিতে ভিড়ার সেই সুযোগ দেননি রাজশাহী তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা ও বিএনপির চেয়ার পার্সনের বর্তমান উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সদ্য সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের কাছে। লিটনের হাত ধরে শাহরিয়ার আলম আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেন। এর পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি শাহরিয়ারকে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও পেয়ে এমপিও হয়ে যান শাহরিয়ার আলম।


বিজ্ঞাপন

নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফ নামায় দেখা যায়, রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসন থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেন শাহরিয়ার আলম। ওই নির্বাচনে হলফনামায় তিনি যে তথ্য দেন-তাতে স্থাবর অস্থাবর সম্পদ (টাকা, সোনা, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) ছিল ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা মূল্যের। বার্ষিক আয় ছিল ৯৮ লাখ টাকা। সে সময় তাঁর মালিকানাধীন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ ছিল ৬৯ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু ২০১৪ সালের দশম নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শাহরিয়ার আলম। ওই সময়ে দেওয়া তাঁর গলফ নামায় দেখা যায়, ৫ বছরের ব্যবধানে আয় বেড়ে ১৪ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

ওই নির্বাচনে জয়ী শাহিরয়ার আলম পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পর হয়ে উঠেন আরও বেপরোয়া। এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তিনি তৈরী করেন দূরুত্ব। একের পর এক মামলা-হামলা চলতে থাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামেই। সঙ্গে চলতে থাকে বিএনপি-জামায়াতকে নিপীড়নের মিশন। শাহরিয়ারের নাম করে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সিরাজুল ইসলাম বাঘা-চারঘাটে নিয়োগ, বদলি, টেন্ডার বাজি, টিআর-কাবিখা আত্মসাত থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নাই সেটি করেননি। এর ফলে সিরাজও কয়েক বছরের মধ্যে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এখন শত কোটি টাকার মালিক তিনিও। ঢাকায় রয়েছে তাঁর দুটি বাড়ি, গাড়ী অগাধ সম্পদ। আর শাহরিয়ার আলমের রয়েছে ঢাকা, রাজশাহী, বাঘায় চারটি বাড়ি। ৫ বছরের ব্যবধানে বিপুল আয় নিয়ে ওই সময় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে চতুর শাহরিয়ার ২০১৮ সালের নির্বাচেন গিয়ে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে হলফ নামায় আয় কম দেখান। সে নির্বাচনের হলফ নামায় তাঁর আয় নেমে গিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো।

২০১৪ সালে ৩১ কোটি ১৯ লাখ ও ২০১৮ সালে ৬৫ কোটি ৭২ লাখ অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন। সেটি ২০২৪ সালের নির্বাচনে গিয়ে ৮৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তাঁর নগদ ও ব্যাংকে টাকা ছিল ২১ কোটি ৪৫ লাখ। বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ারের মাধ্যমে বিনিয়োগ দেখিয়েছিলেন ৬৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

হলফনামা অনুযায়ী, ২০০৮ সালে প্রতিমন্ত্রীর কোনো স্থাবর সম্পদ (জমি, ভবন ইত্যাদি) ছিল না। এখন তাঁর ১৭ একরের কিছু বেশি কৃষি ও অকৃষি জমি রয়েছে। রাজধানীর গুলশানে দুটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক তিনি। রাজশাহীতে চারতলা একটি ভবন (কার্যালয় ও বাসা) নির্মাণ করছেন তিনি। কিন্তু আড়ানির ৫ তলা বাড়ি, চারঘাটের ছাতরায় গার্মেন্ট কারখানা করার নামে কেনা এক বিঘা জমি, রাজশাহীর পদ্মা আবাসিকে তাঁর ভাইদের সঙ্গে শেয়ারে করা বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের তথ্য, গোদাগাড়ীতে কেনা ৩০ বিঘা জমির তথ্য গত নির্বাচনের হলফ নামায় গোপন করেছিলেন বাকপটু এ আওয়ামী লীগ নেতা।

গত নির্বাচনের হলফ নামায় শাহরিয়ার আলম বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৭ কোটি ৯৩ লাখ লাখ টাকা। টানা তিন মেয়াদে এমপি থাকা শাহরিয়ার আলমের সম্পদ বেড়ে যায় প্রায় ৩০ গুণ। স্ত্রী ও সন্তানদের নামে আছে সাড়ে ৭ কোটি টাকার সম্পদ।

প্রতিমন্ত্রীর দুই ছেলের সম্পদ ও আয় বেড়ে যায় গত ১০ বছরে। গতবারের হলফনামায় তাঁদের বার্ষিক আয় ছিল ১২ লাখ ২৫ হাজার ৮০০ টাকা। গত নির্বাচনে সেটি গিয়ে দাঁড়ায় ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৪ টাকা। দুই ছেলের অস্থাবর সম্পদ ছিল ৭৯ লাখ টাকা। সেটি ৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় দাঁড়ায় গত ৫ বছরে।

বাঘা উপজেলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু অভিযোগ করে বলেন, ‘শাহরিয়ার বাড়ি রাজশাহী শহরে। বাঘা-চারঘাটে তাকে কেউ চিনত না। কিন্তু টাকার জোরে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বাঘা-চারঘাটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামেই একের পর মামলা করিয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও করেছেন খারাপ আচরন। তাঁর পশ্রয়ে বাঘার আড়ানি পৌরসভার সাবেক মেয়র অস্ত্রবাজ মুক্তার আলী হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া। তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সিরাজও শত কোটি টাকার মালিক।

বাঘার আগানী এলাকার শামসুদ্দিন নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, ‘শুনেছি শাহরিয়ার শেষ পর্যন্ত ২২টি গার্মেন্টের মালিক হয়েছিলেন। তাঁর অগাধ সম্পতি। সবমিলিয়ে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে শাহরিয়ার আলম আমাদের সামনেই বলতেন। তিনি নিজে মুখেই বিভিন্ন স্থানে সে কথা বলতেন। কিন্তু হলফ নামায় এসব তথ্য দেখিনি। তার সাঙ্গ-পাঙ্গরাও শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু বাঘা-চারঘাটের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হয়েছেন বঞ্চিত। এ কারণে গত দুটি নির্বাচনেই তাঁর বিপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতারাই প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে কারচুপি করে শাহরিয়ার জয়ী হয়েছেন প্রতিবারই। এ ছাড়া তিনি একটি বারও জিততে পারতেন না।’

চারঘাটের বিএনপি কর্মী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শাহরিয়ার ইন্ধনে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টি মামলা হয়েছে। তিনি বাঘা-চারঘাটের বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা করে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এলাকায় তাঁর দলের নেতাকর্মীদের কাছেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। শুধুমাত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চামচামি করে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার।’ তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম পলাতক থাকায় তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

কমিশন বাণিজ্যই ছিল পিএস সিরাজরে হাতিয়ার::  বাঘা-চারঘাটের নেতাকর্মীরা বলছেন, রাজশাহীতে পিএস সিরাজ নামে পরিচিত সিরাজুল ইসলাম এখন কোটিপতি। গত কয়েক বছরে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছে বিপুলভাবে। বাস করেন ঢাকার মিরপুরের ডিওএইচএসে কোটি টাকার ফ্ল্যাটে। একাধিক গাড়ি কিনে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। এখন বিলাসী জীবন তার।মাঝে মাঝেই স্বদল-বলে বিদেশ ট্যূরও করেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সব আর্থিক দিক এখন তারই হাতে। ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিয়মিত খবরদারিও করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিএস সিরাজকে ঘিরেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তার নির্বাচনী এলাকা বাঘা-চারঘাটের দলীয় নেতাকর্মীদের দীর্ঘ টানাপোড়েন শুরু হয়। তার দাপটে অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। ফলে তারা প্রতিমন্ত্রীর পাশ থেকে সরে গেছেন অনেকদিন আগে।

সিরাজের রাজশাহীতে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে বিভিন্ন মহলে। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) এলাকার ওই সময়ের এমপি শাহরিয়ার আলমের গণযোগাযোগের কাজ শুরু করেন। সাবেক এমপি শাহরিয়ার আলম নির্বাচনী এলাকায় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিলে সেসব খবর প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে স্থানীয় পত্রিকায় প্রচারের ব্যবস্থা করতেন। এভাবেই সিরাজ হয়ে ওঠেন তৎকালীন এমপি শাহরিয়ার আলমের ডান হাত। একাধিক ভুক্তভোগী নেতা বলছেন, তার মতামত ছাড়া এলাকার কোনো নেতাকর্মীর কোনো কাজে হাত দিতেন না সাবেক প্রতিমন্ত্রী।আর সেখান থেকেই কমিশন বাণিজ্যে মেতে উঠেছিলেন সিরাজ।

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় গিয়ে শাহরিয়ার আলম পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে সিরাজকে তিনি নিয়োগ দেন সহকারী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (এপিএস) হিসেবে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া।

দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, এপিএস সিরাজ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীর টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগে করেন বাণিজ্য। চাকরি ও বদলিসহ বিভিন্ন কাজে নেন মোটা টাকা। শাহরিয়ারের নির্বাচনী ব্যয়ও ছিল তার হাতেই। ফলে নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রচারের জন্য হাত পাততে হয়েছে সিরাজের কাছেই।

বাঘা উপজেলা যুবলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাঘা-চারঘাটে প্রতিমন্ত্রীর রাজনীতি নষ্টের মূল নায়কই হচ্ছেন পিএস সিরাজ। বাঘায় দুই নেতা ছিলেন সিরাজের টাকা-পয়সা সংগ্রহের মূল এজেন্ট। চারঘাটেও অনুরূপ দু’জন এজেন্ট ছিল সিরাজের। তাকে টাকা না দিলে কারও টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও সরকারি বরাদ্দ ছিল। টনপ্রতি সিরাজ নিতেন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।এর বাইরে বিদেশে ভিসা বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্যও ছিল সিরাজের অন্যতম টাকার মেশিন। এভাবে সিরাজ শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *