ভূমি অধিগ্রহণ শাখার চার সার্ভেয়ার :  ভুয়া  পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, জাল দলিল, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভুয়া  ওয়ারিশ সনদ তৈরির মাধ্যমে একজনের পাওনা অনেকে পাইয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা 

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত চট্টগ্রাম জাতীয় প্রশাসনিক সংবাদ বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

!  জালিয়াতির ঘটনায় গত চার বছরে চট্টগ্রাম আদালতে এরকম ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব দুর্নীতিতে ২৩ সার্ভেয়ার ও কানুনগোর নাম জড়িয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন– সার্ভেয়ার আব্দুল মোমিন, রফিকুল ইসলাম, ইমাম হোসেন গাজী, মাহাবুব হাসান দীপু, আবু কাউসার সোহেল, মোক্তার হোসেন, কমল কান্তি দে, আল আমিন, আমানাতুল মাওলা, মো. জোবায়ের, শহীদুল হাসান, খাজা উদ্দিন, মজিবুর রহমান, নূর চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম মুরাদ, শাহাদাত হোসেন, আবদুল কুদ্দুছ, এসএম নাদিম, আশীষ চৌধুরী, কানুনগো সেকান্দর আলী, মো. মমিন, ছায়েদুল হক মজুমদার ও মো. জাহাঙ্গীর।একজন সার্ভেয়ার ১৭ হাজার টাকা বেতন স্কেলে চাকরি করলেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। দুদক হাত বাড়ালেই সার্ভেয়ারের সঙ্গে তাদের গৃহিণী স্ত্রীদেরও কোটিপতি বনে যাওয়ার প্রমাণ মিলছে। সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজন ও তাঁর স্ত্রী স্মৃতি রানী দেবের ১ কোটি ১৪ লাখ টাকার সম্পদ পায় দুদক। গত ২১ জানুয়ারি ৬১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা করে দুদক। গত ২৫ আগস্ট চেইনম্যান নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের ১৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় চার্জশিট দেয় দুদক। নজরুল ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৬৭৬ টাকা বেতনে চাকরিতে যোগ দিয়ে সর্বশেষ ২৩ হাজার টাকা বেতন পান। সার্ভেয়ার আবদুল গফুরের বিরুদ্ধে ৪২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। কোটিপতি সার্ভেয়ার এস এম নাদিম, আবদুল কুদ্দুছ, শহিদুল ইসলাম মুরাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদককর্ণ ফুলী টানেল প্রকল্পে আনোয়ারার ছাতুরি ও বেলছুড়া মৌজার অধিগ্রহণ করা ১৬ শতক জমির প্রকৃত মালিক নাজিম উদ্দিন। কিন্তু জাল কাগজপত্র দাখিল করে সার্ভেয়ারদের কারসাজিতে ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করেন জামাল রশিদ নামের একজন। তাঁর জাল কাগজকে সঠিক বলে প্রতিবেদন দেন সার্ভেয়ার আবুল কালাম আজাদ ও কমল দাশ। পরে ক্ষতিপূরণের ১ কোটি ২০ লাখ টাকার চেক পান জামাল। ভুক্তভোগী নাজিম উদ্দিন পটিয়া আদালতে মামলা ও এলএ শাখায় অভিযোগ করলে জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় সার্ভেয়ার কমল ও আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করে জেলা প্রশাসন! !!


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক (চট্টগ্রাম)   :  চট্টগ্রাম নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পে আবুল কালাম আজাদের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। পূর্ব ষোলশহর মৌজার পৌনে ৪ শতাংশ জমির ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে তিনি নথিপত্র জমা দেন ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়। পরে নোটিশও করা হয় তাঁকে। তিনি শুনানিতে উপস্থিত হন। কিন্তু হঠাৎ বদলে যায় সব নথিপত্র। তাঁর সেই জমির ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করেন রাশেদুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি। নতুন রেকর্ডপত্র সঠিক বলে প্রতিবেদন দেন চার সার্ভেয়ার। আজাদের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণের ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার চেক পেয়ে যান রাশেদ।


বিজ্ঞাপন

বিষয়টি জানার পর ক্ষতিপূরণের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন আজাদ। গত ২০ সেপ্টেম্বর করা এ মামলায় চার সার্ভেয়ারসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমে বলেন, সার্ভেয়াররা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কারসাজি করে একজনের চেক অন্যজনকে দিয়ে দিচ্ছেন। আমার ক্ষেত্রে সেরকমই হয়েছে। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর আবেদন করলেও ক্ষতিপূরণে অর্থ পাইনি। অন্য ব্যক্তিকে আমার ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে দেওয়ায় আদালতে সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা করেছি।

শুধু এটিই নয়, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, জাল দলিল, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ওয়ারিশ জমা দিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের পৌনে ৩ কোটি টাকার চেক প্রকৃত মালিকের পরিবর্তে হাতিয়ে নেন জোহুরা বেগম নামের এক নারী। তিনি হাতিয়ে নেন পটিয়ায় ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা পটিয়ার সামছুদ্দিন-কামালের সম্পদের ক্ষতিপূরণের চেক। চেকটি যখনই নগরের যমুনা ব্যাংকের নগরীর জুবিলী রোড শাখায় জোহুরার অ্যাকাউন্টে জমা হয়, তখনই ধরা পড়ে জালিয়াতির ঘটনা। কারণ জোহুরার এনআইডি কার্ড জাল হওয়ায় আগেই তাঁর অ্যাকাউন্টটি স্থগিত করেছিল ব্যাংক।

ফলে জালিয়াতি করে চেক হাতিয়ে নিলেও টাকা তুলতে পারেনি জোহুরা চক্র। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুয়া নথিকে ‘খাঁটি’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন সার্ভেয়ার খাজা উদ্দিন ও চেইনম্যান নেজামুল করিম শামসু। চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তেও জালিয়াতির বিষয়টি উঠে আসে। গত ৩০ আগস্ট ক্ষতিপূরণের চেক জালিয়াতির মামলায় দুই সার্ভেয়ারসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ।

এভাবে একের পর এক জালিয়াতি, কারসাজি এবং নয়ছয় করে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা (এলএ) থেকে প্রকৃত ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ চলে যাচ্ছে প্রতারক ও জালিয়াত চক্রের হাতে। এ অপকর্মে প্রত্যক্ষ সহযোগী সার্ভেয়ার ও কানুগোরা। সার্ভেয়াররা তাদের দাখিল করা প্রতিবেদনে জাল ও ভুয়া রেকর্ডপত্রকে ‘খাঁটি’ উল্লেখ করার কারণেই মূলত এ জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে।

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পে মো. শফিউল্লাহর মালিকানাধীন পশ্চিম ইছাখালী মৌজার বিএস ১২৬৭৫ দাগের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ক্ষতিপূরণ পেতে মৃত শফিউল্লাহর সন্তান সেজে আবেদন করেন মগাদিয়ার বাসিন্দা আবুল খায়ের। জাল ওয়ারিশ সনদ জমা দিয়ে ক্ষতিপূরণের ৩১ লাখ টাকা পান তিনি। ২০২০ সালের ২ জুলাই ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে ক্ষতিপূরণের চেকটি পান খায়ের। পরে আসল ওয়ারিশরা আবেদন করলে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ে।

গত ৭ মার্চ শফিউল্লাহর বড় ছেলে সলিম উল্লাহ দিদার চট্টগ্রাম আদালতে প্রতারণা ও জালজালিয়াতির মামলা করেন। পিবিআই ঘটনার তদন্ত করে সার্ভেয়ারের জালিয়াতির প্রমাণ পায়।
একইভাবে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের জন্য আনোয়ারা উপজেলার বন্দর এলাকার সৈয়দ আহমদ অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করেন। কিন্তু তাঁকে অন্ধকারে রেখে সার্ভেয়ার মোকতার আহমদ প্রতিবেদন দেন ওই জমি ক্ষুদিরাম সিংহ ও পরশুরাম সিংহের। সার্ভেয়ার কারসাজি করে সৈয়দ আহমদের ক্ষতিপূরণের অর্থ ক্ষুদিরামদের পাইয়ে দেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্ষতিপূরণের ১২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সার্ভেয়ার মোকতারসহ চারজনের নামে আদালতে মামলা করেন সৈয়দ।

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে আনোয়ারার ছাতুরি ও বেলছুড়া মৌজার অধিগ্রহণ করা ১৬ শতক জমির প্রকৃত মালিক নাজিম উদ্দিন। কিন্তু জাল কাগজপত্র দাখিল করে সার্ভেয়ারদের কারসাজিতে ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করেন জামাল রশিদ নামের একজন। তাঁর জাল কাগজকে সঠিক বলে প্রতিবেদন দেন সার্ভেয়ার আবুল কালাম আজাদ ও কমল দাশ। পরে ক্ষতিপূরণের ১ কোটি ২০ লাখ টাকার চেক পান জামাল। ভুক্তভোগী নাজিম উদ্দিন পটিয়া আদালতে মামলা ও এলএ শাখায় অভিযোগ করলে জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় সার্ভেয়ার কমল ও আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করে জেলা প্রশাসন।

চার বছরে অভিযুক্ত যত সার্ভেয়ার : 
জালিয়াতির ঘটনায় গত চার বছরে চট্টগ্রাম আদালতে এরকম ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব দুর্নীতিতে ২৩ সার্ভেয়ার ও কানুনগোর নাম জড়িয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন– সার্ভেয়ার আব্দুল মোমিন, রফিকুল ইসলাম, ইমাম হোসেন গাজী, মাহাবুব হাসান দীপু, আবু কাউসার সোহেল, মোক্তার হোসেন, কমল কান্তি দে, আল আমিন, আমানাতুল মাওলা, মো. জোবায়ের, শহীদুল হাসান, খাজা উদ্দিন, মজিবুর রহমান, নূর চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম মুরাদ, শাহাদাত হোসেন, আবদুল কুদ্দুছ, এসএম নাদিম, আশীষ চৌধুরী, কানুনগো সেকান্দর আলী, মো. মমিন, ছায়েদুল হক মজুমদার ও মো. জাহাঙ্গীর।

একজন সার্ভেয়ার ১৭ হাজার টাকা বেতন স্কেলে চাকরি করলেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। দুদক হাত বাড়ালেই সার্ভেয়ারের সঙ্গে তাদের গৃহিণী স্ত্রীদেরও কোটিপতি বনে যাওয়ার প্রমাণ মিলছে। সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজন ও তাঁর স্ত্রী স্মৃতি রানী দেবের ১ কোটি ১৪ লাখ টাকার সম্পদ পায় দুদক। গত ২১ জানুয়ারি ৬১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা করে দুদক।

গত ২৫ আগস্ট চেইনম্যান নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের ১৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় চার্জশিট দেয় দুদক। নজরুল ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৬৭৬ টাকা বেতনে চাকরিতে যোগ দিয়ে সর্বশেষ ২৩ হাজার টাকা বেতন পান। সার্ভেয়ার আবদুল গফুরের বিরুদ্ধে ৪২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। কোটিপতি সার্ভেয়ার এস এম নাদিম, আবদুল কুদ্দুছ, শহিদুল ইসলাম মুরাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

অভিযুক্ত সার্ভেয়ার আব্দুল মোমিন, রফিকুল ইসলাম, ইমাম হোসেন গাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সবাই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাদের ভাষ্য, কোনো অনিয়ম কিংবা জাল রেকর্ডকে খাঁটি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেওয়ার সুযোগ নেই। এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ।

চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, আমি কয়েকদিন আগে যোগদান করেছি। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এলএ শাখায় জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে সে নীতিতে চলছি। কোনো সার্ভেয়ার কিংবা কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ ছাড় পাবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় অনিয়ম ও দুর্নীতি চলেই আসছে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও পরে আবার জাল রেকর্ডকে খাঁটি বানিয়ে চলছে দুর্নীতি। জেলা প্রশাসন চাইলেই এ দুর্নীতি বন্ধ করা খুব বেশি কষ্টকর নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *